হিজাব কোনো ব্যাধি নয় বরং ব্যাধির প্রতিষেধক এবং উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের প্রতীক।

বাংলাদেশী স্যেকুলারদের এক শীর্ষ অনলাইন বুদ্ধিজীবী ছোটদের রাজনীতি, কিংবা ছোটদের অর্থনীতি অথবা সাম্যবাদের ভুমিকা পড়া জ্ঞান নিয়ে আর সাথে কিছু গুগল ঘুটা দিয়ে নানা জ্ঞানের কথা বলেন। দেশ ও বিদেশের রাজনীতির পর্যালোচনা করেন, এমনকি দর্শন নিয়েও আলাপ করেন। এতে কোন অসুবিধা ছিলনা বরং সেই অপরিণত জ্ঞান চর্চায় স্যেকুলারদের চিন্তার গভীরতা বুঝতে পারতাম। এছাড়াও ছোটদের জ্ঞান চর্চারও একটা বাজার আছে। তবে তিনি সম্প্রতি হিজাব নিয়ে লিখেছেন। আমার বন্ধু তালিকার কয়েকজন লাইক দেয়ায় আমার নিউজফিডে লেখাটা আসলো। লেখাটা পড়তে পড়তে আবিস্কার করলাম সেই লেখকের হিজাব সম্পর্কে তীব্র ইন্টলারেন্স আছে। যেটাকে ঘৃণাও বলা যায়। তিনি তার বন্ধুর কথা কোট আন কোট করে লেখাটা শুরু করেছেন। তিনি বন্ধুর বরাতে লিখছেন,

‘এই যে আমাদের দেশের মেয়েরা এখন হিজাব পরা শুরু করেছে, এদেরকে দেখলে আমার ঘেন্না লাগে। যারা মাথার উপর আলতো করে একটা ঘোমটার মতো পরে ওদেরকে অতোটা না, কিন্তু ঐ যে হিজাবিস্তারা আছে ওদেরকে দেখলে রীতিমত বমি আসে।’

তিনি হিজাবকে ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারপরে কেন তিনি ব্যাধি বলেন তা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে,

“হিজাব নামক এই বিচিত্র জিনিসটাকে কেন ব্যাধি বলছি? কারণ এই কিম্ভুতকিমাকার জিনিসটা আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আসেনি। আর এই জিনিসটার পিছনে ফ্যাশন বা স্বাচ্ছন্দ্য চিন্তার চেয়ে বেশী যেটা কাজ করে সেটা হচ্ছে হীনমন্যতা। যারা মাথার উপর এই জঞ্জালটা পরে ওরা নিজেদের বাঙালী পরিচয় নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে বলেই এইরকম উদ্ভট জিনিস পরিধান করে।

এবং আপনি লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন হিজাব নামক এই অদ্ভুত জিনিসটা যারা পরে এরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই একটু মূর্খ প্রকৃতির হয়ে থাকে।“

তিনি লেখার উপসংহার টেনেছেন এইভাবে,

“যে বাঙালী মেয়েটি মাথায় একটা রঙিন কাপড় পেঁচিয়ে চুড়ার মতো করে সেখানে একটা পাত্থর ঝুলিয়ে হুর-এ-আরব সাজতে চাইছে, সাজুক, ওর ইচ্ছা। কিন্তু ওকে দেখলে আমার করুণা হয়, একটু ক্রোধও হয়। বেয়াদব বেআক্কেল বেইমানের দল।“

পুরো লেখায় দুর্বল জাজমেন্ট আর ভয়াবহ রেইসিস্ট ঘৃণা, এই দুই বৈশিষ্ট্য অবশ্য বাংলাদেশের স্যেকুলারদের একচেটিয়া। হিজাব কেন হঠাৎ করেই সারা পৃথিবীতে পুনরুত্থিত হল প্রবল শক্তি নিয়ে সেটা নানা গবেষক নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা চেষ্টা করেছেন। প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনা লেইলা আহমেদের A Quiet Revolution: The Veil’s Resurgence, from the Middle East to America; লেইলা মিসরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখিয়েছেন ৫০ এর দশকে মিসরীয় মহিলারা পশ্চিমা আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করেছিল হিজাব ছুড়ে ফেলে। ৭০ এর দশকে তাঁদের পশ্চিমা আধুনিকতার মোহভঙ্গ হয়। এই মোহভঙ্গকে তারা প্রতিকায়িত করে হিজাব পরিধানের মধ্যে দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ায় হিজাব বিষয়ে আরেকটা গবেষণা হয়, সেটার ফলাফল Beyond the Hijab Debates: New Conversations on Gender, Race and Religion বইতে ব্যাখ্যা করা হয়। সেই বইয়ে হিজাব সংক্রান্ত আর নানা ব্যাখ্যা আর বয়ানের একটা সারাংশ আছে। সেখানে বলা হয়েছে হিজাব উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের একটা প্রতীক যেখানে নারী তার শরীরের অব্জেক্টিফিকেশনের বিরুদ্ধে হিজাবের মাধ্যমে প্রতিরোধ তৈরি করে। খুব ইন্টারেস্টিং মতামত।

লেইলা আহমেদ বলেছেন হিজাবের বৈশ্বিক কারণ অবশ্যই আছে তবে স্থানীয় কারণ ও গুরুত্বপুর্ণ। স্থানীয়ভাবে বাংলায় নারীরা নারীদের পোশাকের আর আচারের মধ্যে দিয়েই তার প্রতিরোধের বার্তা দিয়েছে। বাঙলায় হিন্দু নারীরা ধর্মাচারনে সামাজিক বাধার কারণে তৈরি করেছে “ব্রত”। পুরুষেরা পশ্চিমা পোশাক ধারণ করলেও বাঙালি নারীরা শাড়ি ছাড়েননি। সেই নারী যখন ব্যাপকভাবে কোন একটা নতুন পোশাক স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করে সেটাকে মুর্খতা বা বেয়াক্কেলি বলাটাই বেকুবি।

নারীরা স্পষ্টতই হিজাব পরিধান করে একটা প্রতিরোধের বার্তা দিচ্ছে। নারীরা পশ্চিমা আধুনিকতাকে ত্যাগ করতে চায়। সমাজের ব্যাপক পশ্চিমাকরণ শুরু হয়েছে যখন থেকে তখন থেকেই হিজাবের ব্যবহার ব্যাপকতর হয়েছে। বাংলাদেশ পশ্চিমা আধুনিকতার লিবারেল ভ্যালুজ যতটা না গ্রহণ করেছে তার চাইতে বেশী গ্রহণ করেছে তার বিকৃতিকে। নারীরা নিরাপত্তাহীন হয়েছে আগের চাইতে অনেক বেশী; তাই সেই সময় থেকেই পশ্চিমা আধুনিকতার বিকৃতির বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। আর সেই প্রতিরোধের চিহ্ন পরিধান করে নারীরা পথ দেখাচ্ছে। সেই পথরেখা চিনে নেয়াই আজকের কর্তব্য। আপনি কি চিনতে পারছেন সেই পথরেখা?

প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানি। হিন্দু মেডিকেল ছাত্রী পর্দা হিজাব করছে ছেলেদের টিজিং চোখের আড়ালে থাকার জন্য – নিরাপত্তার স্বার্থে। বাংলাদেশের অনেক পুরানা জেলা শহরে মেডিকেল কলেজ হয়েছে। রেসিডেন্সিয়াল সুবিধার কিছু হয় নাই। ফলে ঐ শহরে থাকতে হয় নিজেকে সামলে। কারণ বলাই বাহুল্য সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে শহরে বদমায়েশদের দৌরাত্ম্য কম না।

সেই বুদ্ধিজীবী সবাইকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বানাতে চায়। ওর খেয়াল নাই “বাঙালি জাতীয়তাবাদ” একটা আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, যেটা সে সবার উপরে চাপাতে চাইতেছে। আপনি চাপাইতে চাইলে প্রতিরোধ আসবেই, সেটা যেই মাত্রায় হোকনা কেন।

কৌতুককর কথা হল, তিনি বলছেন, “এদের ঘরে গিয়ে দেখবেন সেখানে রবীন্দ্রনাথ নেই শেক্সপিয়ার নেই জীবনানন্দ নেই।“। তিনি মনে হয় ঘরে ঘরে জরিপ করেছেন।

তো আর কী এদের শুলে চড়ায় দেন, কারণ আপনার মত না তারা।

যারা সেই স্যেকুলার অনলাইন বুদ্ধীজীবির লেখাটা পুরো পড়তে চান এই লিংকে দেখতে পারেন।

লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন

Share

3 thoughts on “হিজাব কোনো ব্যাধি নয় বরং ব্যাধির প্রতিষেধক এবং উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের প্রতীক।

  1. আপনার প্রতিবেদনটা পড়ার পর আমি ইমতিয়াজ মাহমুদ সাহেবের ফেইসবুক স্ট্যাটাসটাও পড়লাম।ওনার স্টাটাসের পরিপেক্ষিতে আপনি যথার্থই লিখেছেন।কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম ওনার স্ট্যাটাসের কমেন্টগুলো পড়ে।ওখানে যারাই কমেন্ট করেছে সবাই দেখি ওনার স্ট্যাটাসের গুনকীর্তন করেছেন।যেটা আমার কাছে একটু অবাক-ই লেগেছে বটে।একজন মুসলিম অর সচেতন জানলেওয়ালা ব্যক্তি কখনোই এরকম স্ট্যাটাসের সাথে সহমত পোষণ করতে পারে না।এতে করে যা বুঝলাম অসুস্থ মানুষকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য আরো অসংখ্য অসুস্থ মানুষ রয়েছেন।

  2. স্যার,আপনি যথার্থ লিখেছন।
    আমার চোখের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলি….
    একজন নারী যিনি হিজাব ছাড়া,মুখে সাজুগুজু করে,চুল শ্যাম্পু করে বাতাসে উড়ায়ে ওড়নাটা গলায় ঝুলায়ে সকল পুরুষের সামনে,রাস্তা-ঘাটে চলে তাদের সবাইকে আমার নৈতিকতার দিক দিয়ছ খারাপ মনে হয়না এবং তাদেরকে আমি মূর্খও বলিনা,
    কেবল “অল্প নির্বোধ” বলি।

    কারণ,এসব নারীকে সবাই দেখে বুকের উঁচু স্থান,পিছনের কোম্বল ,আউলা চুল , লিপিস্টিক মাখা ঠোট,মুখ দেখে মজা নেয়,ছেলেরা মজাও পায়,তাদের অনেকের মুখে আবার লোলও আসে না ছুঁয়েই স্বাদভোগ কিন্তু তাতেও এসব নারীদের কিছু যায় আসেনা।
    কেন?
    কারণ,তারা এসব জেনেও কিছু মনে করেনা।
    তারা ভাবে,লোকে দেখবে তো কি হয়েছে,দেখুক না!
    লোকেদের দেখার জন্যইতো সেজেছি।

    তারা আবার
    একটু অহংকারী ও একগুঁয়েমিও হয়,যে দেখ আমি অত সুন্দর!
    দেখ!দেখ!!
    একটা গর্ববোধের বিষয় আরকি।

    কিন্তু অপরদিকে হিজাবী নারী,তিনি মনে করেন,আমি কেন এসব অন্যকে দেখাবো?
    আমার স্পর্শকাতর অঙ্গ দেখে লোকেরা কেন মুখ দিয়ে লোল ফালাবে?
    আমি কিছুতেই আমার কোন অঙ্গের অবায়বও দেখাবনা।
    ব্যাপারটা একি সাথে অহংকা ও গর্বের মনে হলেও,
    এই দুই নারীর মধ্যে পার্থক্য হলো…
    ১ম জনের অহংকার ও গর্ববোধ আছে কিন্তু সেল্ফ প্রেটেকশন নেই।
    ২য় নারীর ক্ষেত্রে সেই সেল্প প্রটেকশনটা আছে।
    এক কথায় যাকে না ছুয়ে তার কিছু ভোগ করতে পারবেন না।
    একেই বলে প্রকৃত গর্বিত ও অহংকারী নারী।
    আবার অহংকারের কথা‌ শুনে স্যার আপনি কি ভেবেছেন জানি না,তবে আমি অহংকারকে দুভাবে দেখি।
    ১.নিজেকে বড় ভেবে যত্রতত্র অন্য সব কিছুকে ছোট করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা।(যেটা আমি অপছন্দ করি)
    ২.নিজের ব্যক্তিত্ব রক্ষায় যা পরিত্যাজ্য ও যা গ্রহণীয় তা সঠিকভাবে মেইনটেইন করা।

  3. আপনি নিজেকে অতি চালাক মনে করেন,কিন্তু আপনি নিজেই জানেন না আপনি একজন দ্বিমুখী লোক। এক মুখে বিপরীতমুখী কথা বলেন। রংপুরের সংখ্যালঘু নির্যাতনে যারা দোষী তাদের নিন্দা এড়িয়ে দোষ চাপালেন প্রশাসনের উপর। সেখানে বললেন সংখ্যালঘুরা কেন প্রশাসনকে দোষী না করে হামলাকারীদের দুষছে? অথচ হিজাব না পরা মেয়েদের ইভটিজিং করার দোষ চাপাচ্ছেন ইভটিজিংকারী ছাত্রলীগের উপর। রংপুরের ঘটনায় প্রকৃত দোষীর সমালোচনা এড়িয়ে গেলেন, অথচ হিজাবী ঘটনায় ইভটিজিংকারী দোষীদের দিকেই আঙুল তুলছেন, এটা ভালো কথা। কিন্ত দুই ঘটনায় দুইরকমের নীতি অবলম্বন করাটা কি দ্বিচারিতা হয়ে গেলোনা? খুব সূক্ষ্মভাবে চালাকির নীতি অবলম্বন করতে চান আপনি। কিন্ত এসব ভুয়া নীতি রামছাগল পাবলিকরা খাবে, সচেতন মানুষ নয়। আরেকটা কথা, ইভটিজিং কি শুধু ছাত্রলীগই করে? সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার পথ ছেড়ে প্রকৃত নীতি নৈতিকতার পথে থাকুন, তাতে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পাবেন। দ্বিচারী লোক কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট।

Leave a Reply to Prodip Paul Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter