ভারত ভাগের দায় কি মুসলমানদের আর জিন্নাহর?

মুসলমানরা বা জিন্নাহ কখনোই প্রথমে ভারত ভাগ চায়নি। এটা প্রথমে চেয়েছে কংগ্রেস নেতা লালা লাজপত রাই। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ১৯২২ সালে প্রত্যাহার করার পরে কলকাতা, এলাহাবাদ, দিল্লি এসব স্থানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পর দাঙ্গার এক নিদারুন সাম্প্রদায়িক অধ্যায় শুরু হয়।

অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত ভারতব্যাপী অহিংস গণ-আইন অমান্য আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে “গান্ধী যুগ”-এর সূত্রপাত ঘটায়।

এই দাঙ্গার তরঙ্গে সবচেয়ে বীভৎস দাঙ্গা ছিল কোহটের দাঙ্গা। জনৈক হিন্দু পদ্যে একটা পুস্তিকা লিখেন ইসলামকে ব্যঙ্গ করে। পুস্তকটি প্রকাশ করেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোহট শহরের সনাতন ধর্ম সভার সম্পাদক জীবন দাস। ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে, হাজারো মানুষ মারা যায় শতশত বাড়ি ভস্মীভুত হয়।

কংগ্রেস থেকে লালা লাজপত রাইকে এই দাঙ্গার বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়।। এই প্রতিবেদনেই লালা লাজপত রাই ভারত ভাগ করে হিন্দু প্রধান আর মুসলমান প্রধান দুটি দেশ সৃষ্টির প্রস্তাব করেন এবং ভারত ভাগই হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ও হিংসার যথার্থ সমাধান বলে উল্লেখ করেন।

লাজপত রাইয়ের ভারত ভাগের প্রস্তাবের পাচ বছর পরে কবি ইকবাল মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে ভারত ভাগের যেই প্রস্তাব করেন সেটাই “পাকিস্তান প্রস্তাবনা” বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু তিনি সেই বিভক্ত ভারতের একাংশের নাম যে পাকিস্তান হবে সেটা তখনো বলেননি।

১৯৩৩ সালে ইংল্যান্ড প্রবাসী চৌধুরি রহমত আলী কেমব্রিজ থেকে “নাও অর নেভার” নামে প্রকাশিত একটা পুস্তিকায় লেখেন” এই ভুখণ্ডে শান্তি বা প্রশান্তি কোনটাই আসবেনা, যদি আমরা মুসলমানদের প্রতারণা করে একটি হিন্দু প্রধান ফেডারেশনে ঢুকিয়ে ফেলা হয়; যেখানে আমরা আমাদের নিজেদের মঞ্জিলের প্রভু হতে না পারি, আমাদের আত্মার নেতা হতে না পারি।” তিনিই সেই নতুন প্রস্তাবিত দেশের নাম রাখেন পাকিস্তান।

সেই সময় মুসলিম লীগের নেতারা চৌধুরী রহমত আলীর পরিকল্পনাকে কাল্পনিক, অবাস্তব ও বালখিল্য বলে প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রস্তাবের সাত বছর পরে ১৯৪০ সালে লাহোর অধিবেশনে মুসলমান এলাকাগুলোর ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেইট গড়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। সেই অধিবেশনে মুসলিম লীগ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন-এ যে যুক্তরাষ্ট্রের (Federal) পরিকল্পনা রয়েছে সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা বলেন,

১/ ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে ‘অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে,

২/ প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্ত করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (Independent States) গঠন করতে পারে,

৩/ ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের’ সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম।

এই সিদ্ধান্ত অনুসারেই জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলন শুরু করে।

বিশের দশক পর্যন্ত মুসলমানদের বৃহত্তর অংশ ভারত ভাগের কথা ভাবতেই পারেনি, দেশভাগ চাওয়া তো দুরের কথা। তাঁরা চেয়েছিলেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপ থেকে সুরক্ষা ও নিজ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা। অথচ কি আশ্চর্য; ভারত ভাগের পুরো দায় চাপিয়ে দেয়া হয় জিন্না ও মুসলমান সম্প্রদায়ের ঘাড়ে।

লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন

Share

One thought on “ভারত ভাগের দায় কি মুসলমানদের আর জিন্নাহর?

  1. ভারত ভাগের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দাবী ছিলো মুসলিম লীগের ৷ এবং নথিবদ্ধভাবে তাদের দাবীর উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তান সৃষ্টি হয় ৷

    হিন্দু রাজনৈতিক কিছু নেতার এমনতর মন্তব্য থাকলেও এটা তাদের সুসংঘবদ্ধ রাজনৈতিক দাবী ছিলো না ৷

Leave a Reply to Arunav Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter