জামিল, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দিয়ে যায়…

ঘড়িতে একটা বাজতে পাঁচ। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে মোবাইলে ফোন; কিন্তু ওপার থেকে পরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসলো, “পিঙ্কু ভাই, আমি খালেদ”। খালেদ মেডিকেল কলেজে আমার দুই বছরের ছোট ছিল, ছাত্রদল করতো। শেষ দেখা হয়েছিলো তিন বছর আগে। অনেকদিন পরে কথা বলতে পারার উচ্ছ্বাস থামিয়ে খালেদ বলল, “ আজকে ৩১ শে মে, পিঙ্কু ভাই, ঘড়ি দেখেন, ঠিক এই সময় জামিল ভাইকে কুপিয়ে……” খালেদের গলা বাস্পরুদ্ধ হয়ে আসে। খালেদ আর কিছু না বলে অস্ফুটে হয়তো বলল, “রাখি”।

ফোন নামিয়ে রাখি। তাকিয়ে থাকি ক্যালেন্ডারের দিকে। ২৪টি বছর কেটে গেছে গেছে এরই মধ্যে। কিন্তু কিছু রক্তের ঋণ শোধ করা যে এখনও বাকী রয়ে গেছে ! স্মৃতির পাতা উল্টে ফিরে গেলাম রাজশাহী মেডিক্যালে, আমার ছাত্রজীবনে।

সাল ১৯৮৮, তারিখ ৩১ মে। দল-মত নির্বিশেষে অনেকের কাছেই এক দুর্বহ স্মৃতির একটা দিন। ২৪ বছর আগের এই দিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি জামিল আকতার রতনকে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে শিক্ষকদের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবিরের গুণ্ডারা।

জামিলের হত্যাকাণ্ড আর দশটা হত্যাকাণ্ডের মতো নয়। আজকাল শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যে নিরন্তর ছাত্র সংঘর্ষ আর রক্তপাতের ঘটনা দেখি আমরা, জামিলের হত্যাকাণ্ডকে সেগুলোর সাথে যেন ঠিক মেলানো যায়না। আজ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে গভীর আর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিলো, ছিলো কিছু ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।

নব্বইয়ের দশকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হয়ে উঠেছিলো সে সময়ের প্রগতিশীলতার প্রতীক, ছোটখাটো গড়নের এক দুর্দান্ত মেধাবী ছাত্রনেতা জামিল আকতার ছিলেন যার মধ্যমণি। আজন্মবিপ্লবী জামিলের চোখে মুখে ছিল এক গভীর স্বপ্ন, শ্রেণীহীন, শোষণহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হতো রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রগতিশীল আন্দোলন আর চিন্তার চর্চা। হয়তো সেকারণেই এই তীব্র আঘাতের টার্গেট করা হয় জামিল ভাইকে।

৩০ মে, রাত। ঘটনার সূত্রপাত হয় সে রাতেই। শিবির মিছিল করছে। এমন সময় অন্ধকার থেকে কে বা কারা আওয়াজ তোলে “ধর-ধর”। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে কোনও সংগঠন মিছিল করলে কেউ “ধর-ধর” করবে এমন সংস্কৃতি কখনও ছিলো না।

একটা মেডিকেল কলেজে সব মিলিয়ে কয়েক’শো ছাত্র থাকে। রাজনৈতিক রেষারেষি হয়তো থাকে, কিন্তু সেটা খুন পর্যন্ত গড়ানো সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একটু অস্বাভাবিক ছিলো। সে সময় রাজশাহী মেডিকেলে শিবির সমর্থন করতো সব মিলিয়ে বড়জোর ৩০-৪০ জন ছাত্র। এই “ধর- ধর শব্দের পরেই শিবিরের সেই মিছিলে এসে জুটল শতাধিক লোক, সবার হাতেই অস্ত্র। সেই অস্ত্র নিয়ে তারা সারারাত চালালো মধ্যযুগীয় মহড়া।

সকাল হতেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিছিল নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারক লিপি দিলো এবং অভিযোগ করলো, মেইন হোস্টেলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে অস্ত্রসহ শিবিরের অনেক বহিরাগত অবস্থান করছে। ততক্ষণে একাডেমিক কাউন্সিল এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে করণীয় কি, তার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নিয়ে মিটিংয়ে বসে গেছেন। ছাত্রদের অভিযোগ শুনে একাডেমিক কাউন্সিল সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মিটিং থেকেই অধ্যক্ষ সহ প্রায় তিরিশ জন শিক্ষকের একটি দল মেইন হোস্টেলে যান। কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে জামিল ভাইও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

শিক্ষকরা যখন মেইন হোস্টেলে ঢুকতে যান, তখনই বাধা আসে সেখানে অবস্থানরত শিবিরের ক্যাডারদের কাছে থেকে। এর মধ্য থেকে কয়েকজন বহিরাগত শিক্ষকদের সাথে উদ্ধতভাবে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। জামিল ভাই সেই বহিরাগতদের দেখিয়ে বলেন, “এই দেখুন স্যার, বাইরের লোক।“

এর মধ্যেই হঠাৎ এক অপার্থিব তীব্র হুইসেলের শব্দ আর “নারায়ে তাকবীর” বলে শিবিরের শতাধিক অস্ত্রধারী গুণ্ডা শিক্ষকদের সামনেই কাপুরুষের মতো নিরস্ত্র জামিল ভাইকে ধাওয়া করে। এর পরের অংশ শুনুন একাডেমিক কাউন্সিলের বিবৃতি থেকেঃ

“জামিল হত্যাকান্ডের ব্যাপারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলর আজ এক বিবৃতি দিয়েছে । এতে বলা হয়ঃ প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে গত ৩১ শে মে বেলা আনুমানিক ১১টায় কলেজের সাধারণ ছাত্ররা মিছিল সহকারে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এসে অভিযোগ করে, ইসলামী ছাত্র শিবিরের ছত্রছায়ায় একদল বহিরাগত অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রধাণ ছাত্রাবাসের পশ্চিম উত্তর ব্লকে অবস্থান করছে এবং কলেজে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে । তখন একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী  কাউন্সিলের সদস্য ও অন্যান্য শিক্ষক অবস্থা দেখার জন্য ছাত্রাবাসে যান । ছাত্রাবাসের দুটি ব্লক দেখে পশ্চিম-উত্তর ব্লকে যাবার সময় কিছু ছাত্র তাদের বাধা দেয় । এদেরকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্য ও সমর্থক বলে চিহ্নিত করা হয়। যারা বাধা দেয় তারা দাবী করে যে, তাদের প্রত্যেকের ৫জন করে অতিথী আছে এবং কোনমতেই ঐ ব্লক পরিদর্শন করা যাবে না। এর পরেও সেদিকে যাবার সময় তারা বাঁশী বাজিয়ে ’নারায়ে তকবির’ শ্লোগানসহ মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে এসে নীচে দন্ডায়মান সাধারণ ছাত্রদের ধাওয়া করে । ঐ অবস্থায় জামিল আখতার রতন নামে ৫ম বর্ষের একজন ছাত্রকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পর সে মারা যায় । উল্লেখ্য, ছাত্রাবাস থেকে আসার সময় ঐ উচ্ছৃংখল হাঙ্গামাকারিরা আবার বাধা দেয় । এ সময় গাড়ী ভাংচুর এবং বোমা নিক্ষেপ করা হয় ।”

২ রা জুন দৈনিক সংবাদে জামিল হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচীর সংবাদের শেষে প্রকাশিত হয় সেই বিবৃতি।

জামিল হত্যার পরদিন ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবরঃ

বর্ণনা শুনে এটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত পরিকল্পিত। স্বৈরাচার বিরোধী অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতির সবচেয়ে ক্ষুরধার নেতৃত্বকে সরিয়ে হত্যা আর দখলের রাজনীতি শুরুর টেস্ট কেস। এর সূত্র ধরেই শিবিরের দখলের তাণ্ডব শুরু হয় দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পর্যায়ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা দেশে। স্বৈরাচারী শাসনকালের শেষ দিকে যেন শিবিরকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিরুদ্ধে, তাই স্বৈরাচার আর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই হয়ে উঠেছিল সমার্থক।

পরদিন ইত্তেফাকে জামিল ভাইয়ের দাফনের খবর।

জামিলের সেই আত্মদান আজকের প্রজন্মের কাছে এক অবিস্মরণীয় প্রেরণা হতে পারে। আজকের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, ৯০ এর আগুনঝরা দিনগুলো দেখেনি, দেখেনি স্বৈরাচার আর সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দেয়ার অদম্য সাহস; দেখেছে শুধু ছাত্র সমাজের নষ্ট, কলুষিত, পচে যাওয়া সময়।

ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমনে নানা সময় বিরোধী দলকে ক্যান্টনমেন্টের ভয় দেখাতেন। এরশাদের সেই হুমকির জবাবে ছাত্র আন্দোলনকে দেখিয়ে বাম নেতা নির্মল সেন বলেছিলেন, “মিস্টার প্রেসিডেন্ট, ক্যান্টনমেন্টের ভয় দেখাবেন না। আমাদেরও ক্যান্টনমেন্ট আছে।“  বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক দুর্ভেদ্য দূর্গ, সেগুলোকে ক্যান্টনমেন্ট বলা যায় বৈকী !  নির্মল সেনদের সেই দুর্ভেদ্য ক্যান্টনমেন্টে আজ মৃত্যুপুরীর মতো সুনসান নীরবতা ! সেই ছাত্র সমাজ আজ আর দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক নয়, শোষণহীন জীবনের স্বপ্নবুননের কেন্দ্রবিন্দু নয়। আজ আর সেইসব ক্যান্টনমেন্ট তেমনি করে গর্জে ওঠেনা প্রতিবাদে। আজ আর তেমনি করে জন্ম নেয়না দ্রোহ আর বিপ্লবের জামিলরা।

প্রশ্ন ওঠে, সত্যিই কি জন্মায় না ? নাকি আমরা জন্মাতে দিই না ? এ মাটি বিপ্লব জন্মের মাটি, যুগে যুগে এ মাটি প্রসব করে এসেছে নির্ভীক বিপ্লবীদের। ইতিহাস তাদের ভুলে যায়নি, স্বর্ণাক্ষরে নিজের বুকে লিখে রেখেছে হাজারো বিপ্লবীর নাম। শুধু ভুলে গেছি আমরা। এক আত্মবিস্মৃত-ইতিহাসবিকৃত জাতি হিসেবে দিনের পর দিন আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি কিছু প্রতিক্রিয়াশীলতার জঞ্জাল। যখন জাতির পতাকা খামচে ধরে পুরনো সেইসব ধর্মান্ধ শকুন, তখন মনে পড়ে যায়, শোকের কান্নার অঝোর বৃষ্টির পরেও রক্তের দাগ ধুয়ে যায়নি। জামিল নিজের রক্ত দিয়ে ঋণী করে রেখে গেছেন একটি ছাত্রসমাজকে, একটি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসকে।

মনে পড়ে, সেই ঋণ শোধ করতে এখনও আমাদের পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। আজও ছাত্রসমাজের একটি অংশের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে মিশে আছে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষ। সেই বিষবৃক্ষের ফল খেয়ে বিষাক্ত হয়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের ছাত্ররা। যতোবার দেখি বিষাক্ত কোনও প্রতিক্রিয়াশীল নতুন প্রজন্মকে, ততবার মনে পড়ে যায় সেই ৩১ মে’র রক্তাক্ত দিনটি। লজ্জায় নিজেকে বড় অসহায়, বড় ব্যর্থ বলে মনে হয়। একজন জামিলের অভাব আমরা আজও সঠিকভাবে পূরণ করতে পারিনি। জামিল, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দিয়ে যায়, বড় অপরাধী করে দিয়ে যায়।

জামিল ভাইয়ের মৃত্যুর পর কেটে গেছে ২৪টি বছর। স্বদেশকে যে ভালোবাসতো মায়ের মতো, সেই মাটি মায়ের সাথে মিশে গেছে জামিলের নশ্বর শরীর। হয়তো সেই মাটিতেই অনেক আশা নিয়ে প্রতীক্ষায় কান পেতে আছে এক আজন্ম বিপ্লবী। কান পেতে থাকবে, শুধু একবার শোষণ মুক্তির সেই বিপ্লব বিজয়ের বিউগল ধ্বনি শোনার জন্য।

কবে শোনা যাবে বিপ্লব বিজয়ের সেই পরম আরাধ্য সুর ?

Share

3 thoughts on “জামিল, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দিয়ে যায়…

  1. এই পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী মানুষ নিয়ে যতই ভাবি ততই যেন নানা বিস্ময়ে বিস্মিত হই!

  2. দাদা আল্লাহ তায়ালা আপনাদেরকে সুস্থতা দান করুক। আপনাদের দ্বারা দেশের কল্যান ছাড়া অকল্যান যেন আল্লাহ তায়ালা না করান।

    আপনার এই লেখার সাথে বর্তমান আপনার অবস্থান পুরোটাই বিপরীত। আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে এটার ব্যাখ্যা কিভাবে দিবেন।
    ভালো থাকেন।

  3. শিবির হচ্ছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস, এদের সাথে আপনি তর্কেও পারবেন না, এরা ছাত্রলীগের চাইতেও ভয়ংকর। এদের চরিত্র হচ্ছে গুপ্ত হত্যা,প্রকাশ্যে মব করে হত্যা। ছাত্রলীগের পাশাপাশি এদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা জরুরি

Leave a Reply to Mid Shafiuzzaman Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter