আসিফ মহিউদ্দিনকে আমাকে চেনায় আমার এক সিপিবির বন্ধু। আমাকে ২০১২ সালের প্রথম দিকে তিনি আসিফের একটা লেখার লিঙ্ক দিয়ে বলে, পড়ে দেখুন, ভালো লেখে ছেলেটা। পড়লাম লেখাটা, একটা কবিতা। আমি কবিতা ভাল বুঝিনা, কিন্তু কবিতায় একটা রাষ্ট্রের যে রুপকল্প তুলে ধরেছে তা চমৎকার। সেই কবিতার পুরোটা মনে নেই, এমন ছিলো, যে মন্ত্রী পাবলিক বাসে উঠছে, বাসে সিট নেই। সেখানে সসন্মানে তার জন্য সবাই জায়গা ছেড়ে দিতে চাইলেও মন্ত্রী সেই সিটে না বসে, বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যাত্রা সম্পন্ন করেন। এই ধরণের নানা ইউটোপিয় কল্পনা দিয়ে কবিতাটা লেখা। কল্পনা হিসেবে সুন্দর সন্দেহ নাই। যে তরুণ এমন স্বাপ্নিক রূপকল্পের কথা লেখে কবিতার ভাষায় সঙ্গত কারণেই অনেকের তার বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হবে। এরপর তাঁর অন্য লেখাগুলো পড়তাম, বুঝতাম ছেলেটা নাস্তিক, চিন্তা এখনো দানা বাধেনি, কিন্তু গদ্যলেখার হাত ভালো-ঝরঝরে। এদিক থেকে মনে হতো ছেলেটার পটেনশিয়াল আছে। এই বয়সে তো আমিও এমন ঝরঝরে লিখতে পারতাম না। এরমধ্যেই তাঁকে ফেবুতে বন্ধু রিকুয়েস্ট পাঠাই, সে সেটা গ্রহণও করে।
তখন আমি সিপিবি করি পুরোদমে। একদিন সিপিবির ওয়েব সাইট দেখতে দেখতে দেখি সিপিবির ওয়েব সাইটের কভারে আসিফের ছবি তাও আবার মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের পাশে। অনেক পরে আসিফ নিজেও আমাকে এই ছবিটা দেখায়। তার লেখার ধরণ, ফেবুতে আমাদের কমন বন্ধু আর সিপিবির ওয়েব সাইটের কভারে সেলিম ভাইয়ের সাথে তার ছবি দেখে আমি ধরেই নিয়েছিলাম ছেলেটা সিপিবি করে। ন্যাচারালি ফেলো কমরেড হিসেবেই আমি তাঁকে দেখা শুরু করেছিলাম।
এরমধ্যেই একটা জিনিষ লক্ষ্য করি যে, ছেলেটা নাস্তিক হলেও তার মুল বিদ্বেষটা বিশেষত ইসলামের উপরে। সে মনে করে যেন অন্য কিছু নয়, ইসলাম ধর্মটাই একটা সমস্যা। নাস্তিকতার পাশাপাশি সে আবার দেখি গৌতম বুদ্ধের জয়গান গায়। এসব দিক বিচারে একদিন আমি তাঁকে বলি যে আপনি ইসলাম ধর্মকে কুপাইতেছেন কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের জয়গান গাইছেন, সেই বৌদ্ধ ধর্মকে আশ্রয় করেও রিলিজিয়াস ভায়োলেন্স হয় এটা জানেন কী? একটা বইও আছে এনিয়ে, আপনার পড়া আছে? সে বলল পড়ে নাই। আমি তার ই মেইল চাই এবং সে ইনবক্সে ই মেইল এড্রেস দিলে আমি তাঁকে বইটা ই মেইলে পাঠাই। এর প্রায় মাস দেড়েক পরে একদিন আবিষ্কার করলাম, আমার এক আত্মীয়ের সে বন্ধু। আমার সেই আত্মীয়, স্বাভাবিকভাবেই আমার অফিসে আসতো মাঝে মাঝেই। আমি বললাম তোমার এই বন্ধুকে একদিন নিয়ে এসো। তো আমার সেই আত্মীয় সম্ভবত তাঁকে বলাতে একদিন আসিফ নিজেই একা আমার এখানে এলো। আমার একটা অবজারভেশন বলে, যারা ভালো লিখে তাঁদের অনেকেই ভালো বলতে পারেনা। আমার এই অবজারভেশন তার ক্ষেত্রেও সত্য হল। দেখলাম, কথায় সে লেখার মত চোস্ত নয়। যাই হোক জিজ্ঞেস করলাম, বইটা পড়েছেন কিনা, সে নেতিবাচক উত্তর দিলো। আমি কিঞ্চিৎ হতাশ হলাম। আমার সাথে সেদিন তাঁর যে কয়টা কথা হয়েছিল তা ছিলো তার প্রতি আমার পরামর্শমূলক। যেমন, তার চিন্তা আর লেখার মান কীভাবে আরো বাড়াতে পারবে তা নিয়ে, কী কী তার পড়া উচিৎ সেটা নিয়ে। এরমধ্যে একটা পরামর্শ ছিল, দর্শন যেন সে পাঠ করতে শুরু করে। এই পাঠের জন্য আমি তাঁকে প্রয়োজনীয় বই দিতে পারি সেটাও জানিয়ে দেই। এটাও বলি, আপনি চাইলে এই দর্শনের বিষয়ে আমার সাথে আলাপ করে দেখতে পারেন। আমি সেদিন তাঁকে দেকার্তের আমার অনুবাদটাও উপহার দেই।
মজার কথা হল সেদিন, আমার তার কাছে নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দেবার কোন সম্ভাবনাই ছিলো না। কারণ তরুণ বয়সে নাস্তিকতার চর্চা করলেও ২০০২ সালে আমি যখন দর্শন পড়তে শুরু করি তখন বুঝি চিন্তার ইতিহাসে নাস্তিকতা একটি তুচ্ছ এবং অনুল্লেখযোগ্য ধারা। আমি সেই সময় থেকেই অজ্ঞেয়বাদী বলে নিজেকে পরিচয় দেই, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা তাই রসিকতা করে আমাকে মাঝে মাঝে “হাফ নাস্তিক” বলে ডাকে। তাই আমার ধারণা হয়ত আসিফের স্মৃতিশক্তি এব্যাপারে দুর্বল। মোট কথা আমি সেইদিন নিজেকে নাস্তিক বলে তার কাছে পরিচয় দিয়েছি এটা সঠিক হতে পারেনা। যা হোক ভুল শোনা বা পারসেপশনের কারণে এটা হতেই পারে।
আর হ্যা, অতিথিকে আপ্যায়ন করার শিক্ষা আমার পরিবারের শিক্ষা। আমাদের সমাজের শিক্ষাও তাই। আমার আতিথ্য যারা নিয়েছেন তাঁরা সবাই আতিথ্যের বিষয়ে আমার বাড়াবাড়ির কথা অবগত আছেন। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু একদিন আমার খাবার নিয়ে চাপাচাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিল, দাদা খাবারটা আপনার কিন্তু পেটটা তো আমার, আমি এতো খেতে পারবনা, চাপাচাপি করলেও পারবোনা। আমি অতিথিকে এখনো নিজের হাতে চা বানিয়ে দিতে পছন্দ করি। আসিফের চিন্তার সাথে আমার যতই বিরোধ থাকুক, আমি তার চিন্তাকে যতই বিপদজনক মনে করিনা কেন, একজন মানুষ হিসেবে সে যতবার আমার সামনে আসবে, আমাকে সে যতই অসন্মান করুক না কেন, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে আমার পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার অনুষঙ্গ হিসেবে আমি তাকে একই আপ্যায়ন করবো। আমার আতিথের্য বাড়াবাড়িকে যে কেউ নেতিবাচক হিসেবে নিতে পারে সেটা আমি জীবনে প্রথম দেখলাম ।
বাংলাদেশে অনেকেই সিরিয়াসলি নাস্তিকতার চর্চা করে গেছেন ড আহমেদ শরিফ, আরজ আলী মাতুব্বর। তবে উনারা কখনই খেয়ে না খেয়ে ইসলামের পিছনে লাগেননি। এদিকে বুশ ব্লেয়ারের ওয়ার অন টেরর প্রজেক্টের পরে “নাস্তিকতার” নামের আড়ালে এক “মিলিট্যান্ট ইসলামবিদ্বেষের” উদয় হতে দেখেছি আমরা যা ওয়ার অন টেররের উপজাত। আসিফ সেই মিলিট্যান্ট ঘরানার নাস্তিক। তার এই নাস্তিকতা আসলে কোন জ্ঞানের চর্চা নয়, চিন্তার চর্চা নয়, এই নাস্তিকতার সোজা মানে হল, ঘৃণা ছড়ানো। এক কথায়, এই নাস্তিকতা হল রেইসিজম। এই নাস্তিকতায় মানুষের অনুভুতিতে যে উস্কানিমূলকভাবে আঘাত দেয়া হয় তাঁকে এমনকি জাতিসংঘ ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এই বিচারে বলা যায়, ২০১৩ সালে হেফাজত যে ঢাকায় এসেছিল আর এসে রক্ত আর জীবন দিয়েছিলো তার মুল উস্কানিদাতা ছিলো আসিফ মহিউদ্দিনের মত লোকেদের চিন্তা ও তৎপরতা। ওয়ার অন টেররের বরকন্দাজ হিসাবে আসিফ এবং তার সহযোগীরা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো যেন এই প্রাণহানি হওয়ার মতো একটা পরিণতি তৈরি হয়।
ঐ রক্তপাত আর প্রাণহানীর ভিতর আমি আসিফদের চিন্তা ও তৎপরতার দায় দেখি। না, এটা আসিফ কাউকে নিজে হাতে কোপাইছে তা বলা নয়। রেইসিস্ট চিন্তা ও তৎপরতার পরোক্ষ দায় হিসাবে বলছি। সেই দায় নিজ হাতে কোপানোর অপরাধের চাইতে গুনগতভাবে কম নয়।
আমি সত্যই অবাক হই, যখন এখনও দেখি এজন্য আসিফের মধ্যে অনুশোচনা নেই আছে সীমাহীন উদ্ধত্য। সেটাই তো হবার কথা, মানুষকে না ভালোবাসলে, সেই মানুষ যা ভালোবাসে, যা সন্মান করে তাঁকে তো তার না ভালবাসারই কথা, সন্মান না করারই কথা। সে আসলে মানুষকে ভালোবাসতে শেখেনি, নিছক লিবারেল ভ্যালু হিসেবে ভিন্নমত আর ভিন্ন ধারার জীবনকে সন্মান জানানো তো দূর কি বাত।
মানুষকে ভালোবাসতে না পারাটা একটা অপুর্নতা। অপুর্ণ মানুষের জন্য আমার কষ্ট হয়। কি মহান ঐশ্বর্য থেকে সে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করেছে। মানুষের ভুল হয় হতে পারে। কিন্তু মানুষের প্রতি ভালবাসায় সৎ থাকলে ভুল সংশোধনের সুযোগ পায় মানুষ। আসিফের মতো মানুষেরা তাঁদের চিন্তার দীনতার কারণে তাঁদের ভুলগুলো সংশোধনের সুযোগ পাবেনা। আফসোস!!
5 thoughts on “ছেলেটা নাস্তিক হলেও তার মুল বিদ্বেষটা বিশেষত ইসলামের উপরে।”
ভালো হইছে লেখাটা।
perfect description about so called illiterate atheist,i have many atheists friend non of them disrespect others religion.but for sure about this guy he spread hatred among people.he do this not for practicing atheism but for to live.i mean its his profession,sound funny but its true,he is an illiterate person even he didnt pass H.S.C as far as i know about him.he is simply a pure ass hole. thanks for sharing your view about hefazat murder in shapla chattar, asif and a group of anti Islamist person provoked the hefazat to do that type of act on behalf of islam.as well as a big part of government was involved with this,specially pms secretary at that time who suicide later.
একথাটা আমার কাছে খুবি ভালো লেগেছে।
“মানুষকে ভালোবাসতে না পারাটা একটা অপুর্নতা। অপুর্ণ মানুষের জন্য আমার কষ্ট হয়। কি মহান ঐশ্বর্য থেকে সে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করেছে। মানুষের ভুল হয় হতে পারে। কিন্তু মানুষের প্রতি ভালবাসায় সৎ থাকলে ভুল সংশোধনের সুযোগ পায় মানুষ। আসিফের মতো মানুষেরা তাঁদের চিন্তার দীনতার কারণে তাঁদের ভুলগুলো সংশোধনের সুযোগ পাবেনা। আফসোস!!”
.
স্যার,যার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার, মানুষের প্রতি দয়া-ভালোবাসা থাকে সেই প্রকৃত মানুষ;ধর্মের বিচারে ভিন্ন হলেও।
আমি এমন মানুষকে সদা সম্মান করি,সে যে ধর্মের হোক বা নাস্তিক হোক।
প্রিয় দাদা খুব ভালো লাগে আপনার লেখা ,আসিফ কে খুব ভালোভাবে উপস্থাপন করেছেন ,ওর ব্যাপারে আমার একটা অবজাভেশান এই যে ,ও আসলে হঠাত হিরো, ওর বেইজ এ ভালো কিছু পাইনা সেটা লেখা-পড়াই হোক না কেনো ,আর চুড়ান্তভাবে পেইড সেটা যেখান থেকেই হোক না কেনো ।
আমি আপনাকে জেনেছি এক বড় ভাই ,নাট্যকার ,লেখক “রাজুসিদ্দিক” ভাইয়ের কাছ থেকে ।একটু পরামর্শ দেবেন ভালো লিখতে কিভাবে কি কি পড়বো?
ভাল লাগার মত লেখা।