কেরালায় ভারতীয় কমিউনিস্টদের সাফল্যের কারণ কী? বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা কেন অসফল?

ভারত স্বাধীন হবার পরপরেই প্রথম যেই রাজ্যে ভারতীয় কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসে সেটা কেরালা। কেরালার পরে অন্য রাজ্যে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসলেও কেরালার সমাজে কমিউনিস্টদের যে গভীর ভিত্তি আছে তা অন্য জায়গায় সম্ভব হয়নি। এর কারণ কী? কেন কেরালাতে কমিউনিস্টরা সাফল্য অর্জন করলো যেই সাফল্যের ধারা এখনো বহমান?

ভারত স্বাধীন হবার সময়ে কেরালায় ৬০% হিন্দু এবং ৪০% মুসলমান এবং খ্রিস্টান ছিল। এবং কেরালার মুসলমান এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন। এর অর্থ হচ্ছে ভারতবর্ষের মধ্যে ইসলাম এবং খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় প্রথম কেরালার মানুষ। কিন্তু কেন এই বিপুল ধর্মান্তকরন?

এর কারণ খুজতে গেলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে কেরালার তৎকালীন সমাজের দিকে। কেরালার সমাজ ছিল বৈষম্যে আকীর্ণ এবং জাতিভেদপ্রথার উৎপীড়নের জন্য কেরালা ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট। এখানে যারা “দীনের চেয়েও দীন” তারা শুধু যে “অস্পৃশ্যই” ছিল তাই না ছিলো “অপশ্য” (অর্থাৎ চোখের দেখাও পাপ ছিল)। কোন নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ কে আসতে দেখলে পারিয়া মজুরকে আগে থেকেই হাক ছেড়ে জানান দিতে হতো, পাছে প্রভু তাঁকে দেখে ফেলে কলুষিত হন!! জাতিভেদ প্রথার এই নির্মম অবস্থার কারণেই নিম্নবর্ণের অস্পৃশ্য আর অপশ্যরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়।

কেরালার কমিউনিস্টরা তাঁদের রাজনীতি শুরু করেন কংগ্রেস থেকে সেখান থেকে উত্তির্ন হন বামপন্থায়। এই কমিউনিস্টরা নিম্নবর্ণের অস্পৃশ্য আর অপশ্যদের সংগঠিত করে কৃষক সভা গঠন করে রায়তদের নিরাপত্তা দাবী করেন। শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ভূমিহীনদের জন্য ভালো মজুরি এবং উন্নত কর্মপরিবেশ দাবী করেন। প্রচুর ভলান্টারি স্কুল তৈরি করেন কমিউনিস্টরা সেখান থেকে সমাজের দুর্বল অংশের মধ্যে সাম্য আর মানবতার আদর্শবাদ প্রচার করেন। জাতিভেদ প্রথায় দীর্ণ অস্পৃশ্য আর অপশ্যদের কাছে খুব সহজেই সাম্যবাদের আদর্শ মূর্ত হয়ে ওঠে। সমাজে এক বিপুল পরিবর্তন দেখা দেয়। জাতিভেদ প্রথা নিয়ে অগ্রগণ্য গবেষক দিলীপ মেনন লেখেন,

“(কেরালায় কমিউনিস্টদের কাজে) ১৯০০ থেকে ১৯৫০, মাত্র এই পঞ্চাশটি বছরের মধ্যে কেরালার গ্রামাঞ্চলে সম্ভ্রমের বদলে ঔদ্ধত্যই হয়ে উঠেছিল সামাজিক ভাব বিনিময়ের ভাষা

১৯৫৭ সালে নির্বাচনে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে প্রথম রাজ্য কমিউনিস্ট সরকার ভারতে ক্ষমতায় আসে। কেরালার কমিউনিস্টরা সমাজের প্রধান দ্বন্দ্বকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। সেই দ্বন্দ্ব ছিল “জাতিভেদ প্রথার অমানবিক বৈষম্য”।

মাও সে তুং এর মতে কোন পার্টিকে দ্বন্দ্বের অসমতা, প্রধান দ্বন্দ্ব, প্রধান দ্বন্দ্বের প্রধান দিক ইত্যাদির ভিত্তিতে এর রাজনৈতিক ও সামরিক রণনীতি -রণকৌশল নির্ধারণ করতে হয়। মাও এর কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, বিভিন্ন সামাজিক দ্বন্দ্বেরর আপেক্ষিক অবস্হান। মাও গুরুত্ব দিয়েছিলেন সামাজিক দ্বন্দ্বসমূহের আপেক্ষিক অবস্হান অবস্হান বা তাদের অসমতার ডিগ্রীর উপর ভিত্তি করে নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করা। যা কেরালার কমিউনিস্টরা খুব ভালোভাবেই করেছিলেন। জাতপাতের অত্যাচারে দীর্ণ সমাজে জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইকেই তাঁরা মুখ্য করে তুলেছিলেন

আর এদিকে পূর্ব বঙ্গের কমিউনিস্টরা কী করেছেন? যখন কৃষক প্রজা পার্টি পূর্ব বঙ্গে জমিদারি উচ্ছেদের লড়াই করছে এবং কৃষক প্রজা পার্টি সেই কারণেই পূর্ব বাঙলায় দারুণ জনপ্রিয় পার্টি হয়ে উঠেছে। পূর্ব বঙ্গের কৃষকেরা জমির মালিকানার দাবীতে প্রত্যক্ষ শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত তখন পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্টেরা “তেগাভার” লড়াই করছে। কৃষক যেখানে আধা ভাগ দিত জমিদারকে সেখানে তিন ভাগের এক ভাগ দেয়ার লড়াই করছে কমিউনিস্টরা। সেই লড়াই কার্যত কৃষকের লড়াই নয়; মুলত জমদারি হারানোর ভয়ে ভীত জমিদারদের একটা চমৎকার এস্কেইপ রুট । পূর্ব বঙ্গের কমিউনিস্টরা সেই সময়ের চোখের সামনে জ্বলতে থাকা সমাজের প্রধান দ্বন্দ্বকে ধরতেই পারেনি, যা কৃষক প্রজা পার্টি কমিউনিস্ট না হয়েও পেরেছিল।

এখনো কি বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা সমাজের প্রধান দ্বন্দ্বকে ধরতে পেরেছে?

তথ্যসুত্রঃ

১/ Dilip M Menon, Caste, Nationalism and Communism in South India: Malabar, 1900-1948 (Cambridge University press 1994)

২/ Robin Jeffery; Decline of Niar Dominance (1975; 2nd edition New Delhi: Manohar, 2003)

৩/ Robin Jeffery; Politics, women and well-being: How Kerala Became a model (New Delhi: Oxford University press, 1994)

 

Share

One thought on “কেরালায় ভারতীয় কমিউনিস্টদের সাফল্যের কারণ কী? বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা কেন অসফল?

  1. “…..পূর্ব বঙ্গের কৃষকেরা জমির মালিকানার দাবীতে প্রত্যক্ষ শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত তখন পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্টেরা “তেগাভার” লড়াই করছে। কৃষক যেখানে আধা ভাগ দিত জমিদারকে সেখানে তিন ভাগের এক ভাগ দেয়ার লড়াই করছে কমিউনিস্টরা। সেই লড়াই কার্যত কৃষকের লড়াই নয়; মুলত জমদারি হারানোর ভয়ে ভীত জমিদারদের একটা চমৎকার এস্কেইপ রুট।”

    তেভাগা আন্দোলন নিয়ে এটা নতুন ভিউ আমার কাছে। এই ভিউটাকে তাহলে আরো বিস্তৃত করে লিখুন, আপনার লেখা চাই।

    – হক সাজ্জাদ

Leave a Reply to হক সাজ্জাদ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter