আমি মাদ্রাসা প্রেমী নই, আমি মানব প্রেমী

মাটির একটা গুণ আছে। হিটলারের প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলস একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে একটা মিথ্যাকে সত্য বলে বারেবারে প্রচার করলে সেটা একসময় সত্য বলে মনে হয়। ইউরোপের মাটিতে নব্য গোয়েবলসেরা জন্ম নিয়েছে, একজন নয় বেশ কয়েকজন। যাঁদের আর কোন কাজ নেই শুধু আমার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করা ছাড়া। সেজন্য তো ইস্যু লাগবে? সেই ইস্যু দরকার হলে জার্মানির মাটি থেকে আরেক গোয়েবলস সরবরাহ করবে।

এই নব্য গোয়েবলসেরা প্রচার করে যাচ্ছে যে, আমি নাকি মাদ্রাসা শিক্ষার মাহাত্ম্য প্রচার করছি। এটা এতো অসংখ্য বার বলা হয়েছে যে, এটাকে এখন সত্য বলে অনেকের মনে হতে পারে। আমি ঠিক কী লিখেছি বা বলেছি সেটাকে কিন্তু কোথাও কৌট করা হচ্ছে না।

আসল ঘটনা কী? এই বিদেশী চক্রের একজন একসময় আমার স্ট্যেইটাসে এসে জানতে চায় স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশে কোন ধর্মীয় স্কুল আছে কিনা? আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম যে আছে। সে একসময় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল বার্ন্স অ্যান্ড নোবেলস এ কোন জিহাদি বই বিক্রি হয় কিনা, আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম হয়। তারপর সে প্রশ্ন করে ইউরোপের সেই স্কুলে কী অন্য ধর্মের ছাত্রের পড়া মানা কিনা? আমি বলেছিলাম, না মানা নয়। তারপর সে প্রশ্ন করে মাদ্রাসায় কি একজন হিন্দু ছাত্র পড়তে পারবে? এটার উত্তর আমার জানা ছিল না। তাই, আমি এই উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস পড়তে শুরু করি। একটা বই পাই, দ্রাবিড় বাঙলার রাজনীতি” শিরোনামে। বইটা লিখেছিলেন সৈয়দ মবনু। ইউরোপে শিক্ষিত এই সূফী ঘরানার ভদ্রলোকের প্রজ্ঞায় আমি মুগ্ধ হই। এই ভদ্রলোক একজন মাদ্রাসার প্রধান। উনার কাছেই জানতে পারি যে, বাংলাদেশের মাদ্রাসায় অন্য ধর্মের ছাত্রদের পড়তে বাধা নেই যদি তাঁরা সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম মেনে চলেন। এবং বাস্তবিক একসময় হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে মাদ্রাসায় পড়ত। রাজা রামমোহন রায় পাটনা মাদ্রাসা থেকে স্নাতক হন। ব্রিটিশরা এসে হিন্দু মুসলিমের মনে পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসার বীজ ঢুকিয়ে পরস্পরকে দূরে সরিয়ে দেয়। বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়। যার রেশ আমরা এখনো টানছি।

এই আলাপের সুত্র ধরে মবনু ভাই আমাকে উদ্ধৃত করে সিলেটের একটি দৈনিকে কলাম লেখেন। আমি সেটা শেয়ার দেই। এখানে মাহাত্ম্য প্রচার কোথায় হয়েছে? এটা আমার বোধের বাইরে। আমি শুধু বিশ্বাসের, মতের ও পথের পার্থক্য থাকার পরও অন্যকে শ্রদ্ধা করেছি। এটা মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের পরে জাতির জন্য সর্বজনীন অভিন্ন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে না পারার ব্যর্থতা কার? স্বাধীনতার পর জাতি প্রস্তুত ছিলো একটি অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। একমাত্র তখনই সম্ভব ছিলো মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নততর শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা আর ইংরেজি শিক্ষার নামে একটি সুপার এলিট গোষ্ঠী সৃষ্টির চেষ্টা বন্ধ করার। সেই কাজটি কেন করা হয়নি সেই প্রশ্ন না তুলে আমরা তথাকথিত প্রগতিবাদিতার নাম তুলে তাঁদেরকে একটি প্রান্তিক গোষ্ঠীতে পরিনত করে তাঁদের অসহায়ত্ব কে ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ তাঁদের প্রগতিশীল দায়িত্ব পালন করছে। আমরা প্রশ্ন করছিনা, কেন তাঁরা স্যেকুলার শিক্ষার সুযোগ পেলনা। শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত না করে তাঁদের ওপর রাষ্ট্র যখন নির্বিচারে গুলি করে রাতের আলো নিভিয়ে, তখন আমরা খুশি হই। আর, যদি কেউ এর প্রতিবাদ করে, তখন তথাকথিত প্রগতিশীল রা মিলে তাঁকে “মাদ্রাসা প্রেমী” হিসেবে চিহ্নিত করি। আমরা ভুলে যাই, এরাও মানুষ। আমাদের মতোই মানুষ।

আমি মাদ্রাসা প্রেমী নই, আমি মানব প্রেমী, আমি একজন মাদ্রাসা ছাত্রের বঞ্চনা, কষ্ট, স্বপ্ন আর হতাশা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করি।

আপনারা পারেন না সেটা আপনাদের মানবিক ব্যর্থতা। মানবিক ব্যর্থতা নিয়ে আর তার সাথে মিথ্যাচারের মশলা মিশিয়ে আর যাই হোক, দোহাই আপনাদের নিজেদের প্রগতিশীল দাবী করবেন না। প্রগতিশীল শব্দটাকে দয়া করে রেহাই দিন।

Share

6 thoughts on “আমি মাদ্রাসা প্রেমী নই, আমি মানব প্রেমী

  1. আল্লাহ আপনার জ্ঞান আরো বাড়িয়ে দিন।

    ‘আপনার আমানত’ নামে একটা ৩২ পৃষ্ঠার বই আছে আপনাকে বইটি পড়ার অনুরোধ করছি।
    সংগ্রহ করতে না পারলে জানাবেন আমি ব্যবস্থা করে দেব।
    01918675051

  2. প্রকৃত জ্ঞানীদের দেশ নাই,কাল নাই,পাত্রের ভেদ নাই তারা সকল কালের সকল মানুষের। আপনি যদি এ কাতারের হন তবে আপনায় স্মরি হৃদয়ে।

  3. স্যার, মানব প্রেমী অবশ্যই হতে হবে। মাদ্রাসা প্রেমী না হলেও চলবে। যারা আপনাকে মাদ্রাসা প্রেমী বলে তারা এক নির্দিষ্ট গোষ্টীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার লোভে বলে।
    লেখাটা পড়ে ভালই লেগেছে।
    ধন্যবাদ

  4. বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক চাচাতো ভাই পড়ে।
    ইংরেজিতে ক্লাস হয়।
    আমার ভাই বলে,আমি তেমন ভালো বুঝিনা।
    স্যার,আমায় একটু বাংলায় বোঝান।
    এটা বলার পর তাকে অপমান করার পর বলে দিল,ক্লাস ইংরেজিতেই হবে মন চাইলে পড় নইলে চলে যাও।
    সে ল’তে পড়ে।
    এখন‌ আইন হলো বোঝার বিষয়ে যা অতো সোজা নয় বোঝা তার মধ্যে আবার ব্রিটিশ ভাষা!
    এই দেশ থেকে ব্রিটিশ গেল কিন্তু নীল চাষ আর বন্ধ‌ হলো না!

  5. দাদা বলার চেয়ে ভাই বলি,ভালোবাসা আরো বাড়ুক আপনার প্রতি। মাদ্রাসায় জঙ্গি তৈরী হয় এই বক্তব্য দেয় যারা কেউ কোনদিন তদন্ত করনি।আসলে ওরা শুনা কথা নিজে চালিয়ে যাচ্ছে।

Leave a Reply to Musharah Hossain Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter