হিন্দু ধর্মের অবতার তত্ত্ব বিবর্তনের আলোকে পাঠ

হিন্দু পুরান অনুসারে ঈশ্বর পৃথিবীতে অবতার হয়ে জন্ম নেন। দশ জন অবতার আছে হিন্দু ধর্মে। এর মধ্যে নয় জন অবতার এসেছেন দশম অবতার এখনো আসেননি। অবতারের আক্ষরিক অর্থ অবতরণকারী; অবতার বলতে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে স্বেচ্ছায় মর্ত্যে অবতীর্ণ পরম সত্ত্বাকে বোঝায়।

পুরাণ অনুসারে দশ অবতার হলেন:

. মৎস্য, মাছের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ

. কূর্ম, কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ

. বরাহ, শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ

. নৃসিংহ, অর্ধনরসিংহ রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ

. বামন, বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ

. পরশুরাম, পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ

. রাম, রামচন্দ্র, অযোধ্যার রাজপুত্রের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ

. কৃষ্ণ, দ্বাপরযুগে ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে অবতীর্ণ।

. বুদ্ধ, কলিযুগে অবতীর্ণ হন।

১০. কল্কি, সর্বশেষ অবতার। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কলিযুগের অন্তে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে।

 

দশ অবতার

 

এই অবতারগুলো পর্যায়ক্রমে একের পর এক এসেছে। সেগুলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এক বিস্ময়কর সত্য বেরিয়ে আসে। ধর্ম বেশীরভাগ সময় মেটাফরের আড়ালে সত্য লুকিয়ে রাখে। তাই ধর্মকে আক্ষরিক অর্থে পাঠ করলে মুস্কিলে পড়তে হয় বৈকি। অবতার তত্ত্বের মেটাফরের উন্মোচনের আগে আসুন পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তনের ইতিহাসটা একটু দেখে আসি।

পৃথিবীতে প্রাণ স্পষ্ট কয়েকটা যুগের মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে।

 

পৃথিবীর ইতিহাসকে যদি একটা ২৪ ঘন্টার ঘড়ি হিসেবে কল্পনা করা হয় তাহলে যেমন হবে।

/ প্যালিইয়োজোয়িক যুগ, যে সময় পৃথিবী জলমগ্ন ছিল।

/ ডিভোনিয়ানকার্বনিফেরাস যুগ যখন উভচর প্রাণীরা সৃষ্টি হচ্ছে।

/ সিনোজয়িক যুগ যখন সপুষ্পক উদ্ভিদ স্তন্যপায়ী প্রাইমেট বর্গের উদয় হয়েছে।

/ অলিগোসিনমাইয়োসিন যুগ, যখন প্রাইমেটের ট্র্যানজিশন হচ্ছে।

/ প্লাইয়োসিনপ্লাইস্টোসিন যুগ যখন প্রথম তুষার যুগের অবসান হচ্ছে, গভীর অরণ্য ধ্বংস হয়ে তৃণভূমি দেখা দিচ্ছে। এই সময়েই অরণ্যচারী নরাকার প্রাণীরা বাধ্য হয়ে মাটিতে নেমে আসে।

এবার আসুন দেখি অবতারগুলো। প্রথম অবতার মৎস্য। জলময় বিশ্বে মাছই তো একমাত্র প্রানী হবে। প্যালিইয়োজোয়িক যুগে কি সেইজন্যই মাছ অবতার? পুরাণে বলে এসময় ভগবান শ্রী বিষ্ণু মীন (মাছ) হয়ে বেদ উদ্ধার করেছিলেন। এই বেদ মানে কিন্তু কোন গ্রন্থ নয়। বেদ মানে জ্ঞান।

এরপর এলেন দ্বিতীয় অবতার কূর্ম অবতার। মানে কচ্ছপ, উভচর প্রানী; জল ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠতে পারে। ডিভোনিয়ান-কার্বনিফেরাস যুগ যখন উভচর প্রাণীরা সৃষ্টি হচ্ছে।

এরপর এলেন বরাহ অবতার। সে এখন ডাঙ্গার প্রানী কিন্তু জলের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি তাই বাস করে কাঁদায়। সে জলচর প্রানী থেকে বিবর্তিত হয়েছে স্তন্যপায়ী জীবে। সিনোজয়িক যুগ যখন সপুষ্পক উদ্ভিদ ও স্তন্যপায়ী ও প্রাইমেট বর্গের উদয় হয়েছে। এই সময় পর্যন্ত দেখুন অবতার চতুস্পদ।

এরপর এলেন নৃসিংহ অবতার মানে অর্ধেক মানুষ অর্ধেক পশু। অলিগোসিন-মাইয়োসিন যুগ, যখন প্রাইমেটের ট্র্যানজিশন হচ্ছে। নৃসিংহ অবতার হিরণ্যকশিপু নামের দানবকে নখ দিয়ে পেট ছিড়ে হত্যা করে। কশিপু মানে হচ্ছে গ্রাসাচ্ছাদন। হিরণ্যকশিপু গ্রাসাচ্ছাদন নষ্ট করতো। কবিশেখর পণ্ডিত ভুবনমোহন দাস, তাঁর অবতার তত্ত্বে বলেছেন এই গ্রাসাচ্ছাদন হচ্ছে “বনজ কলা”। প্রাণীদের আদি খাদ্য। এই কলা গাছ নষ্ট করতো কেঁচো। নৃসিংহ অবতার সেই কেঁচোকে নখ দিয়ে আলাদা করে হত্যা করে এবং সম্ভবত পরিশেষে খেয়ে ফেলতো। এভাবেই স্বাভাবিকভাবে জন্মানো কলা গাছ রক্ষা পেতো। এবং প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ সম্ভব হতো। কলা প্রাণী কুলের আদিম খাদ্য। তাই হিন্দু ধর্মে কলা সকল রকম মাঙ্গলিক কাজে ব্যবহৃত হয়। কলা ছাড়া কোন পুজাই সিদ্ধ হয়না।

এরপর পঞ্চম অবতার বামন। প্লাইয়োসিন- প্লাইস্টোসিন যুগ যখন প্রথম তুষার যুগের অবসান হচ্ছে, গভীর অরণ্য ধ্বংস হয়ে তৃণভূমি দেখা দিচ্ছে। এই সময়েই অরণ্যচারী নরাকার প্রাণীরা বাধ্য হয়ে মাটিতে নেমে আসে। রামপিথেকাস, শিবপেথিকাস অস্ট্র্যালোপিথেকাস প্রাণীর জন্ম। সে তখন মাঝে মাঝে দু পায়ে উঠে দাঁড়ালেও মাঝে মাঝে হাতের সাহায্য লাগে। এই সময় ধর্ম হলো ত্রিপদ, মানে তিন পা। আর উচ্চতায় সে পূর্ণ মানুষের অর্ধেক তাই সে বামন।

রামপিথেকাস

এরপর এলেন ষষ্ঠ অবতার মানুষের পূর্ণ রুপ নিয়ে পরশুরাম। যার হাতে কুঠার। পরশুরাম ব্রাহ্মণ মানে এখন সে মগজের ব্যবহার জানে। পরশুরাম অগ্নিহোত্রী মানে সে আগুনের ব্যবহারও জানে। পরশুরাম সহস্রবাহু কার্তবির্যাজুর্নকে হত্যা করে, একুশবার ক্ষত্রিয়কুল নিশ্চিহ্ন করে আর আপন গর্ভধারিণী মা রেনুকাকে হত্যা করে। এর মানে কি এই যে তিনি সহস্রবাহু মহীরুহ কে কুঠারাঘাতে কেটে ফেলেন; একুশবার নিঃক্ষত্রিয় মানে জঙ্গল পরিস্কার করেন আর কৃষি কাজের প্রচেষ্টায় ধরিত্রির বুকে অস্ত্রাঘাত করে মাটিকে রেনু রেনু করেছিলেন? এই তাহলে মাতৃরূপি ধরিত্রিকে হত্যা? এখন কিন্তু ধর্ম দ্বিপদ।

কুঠার হাতে আমাদের আদি পিতা

 

এরপর আসলেন সপ্তম অবতার রাম। তিনি ধনুর্বাণধারী। তিনি প্রস্তরীভূত অহল্যাকে উদ্ধার করলেন। এর মানে কি এই তিনি হলের (লাঙ্গলের সাহায্যে) অনাবাদী জমি যা আসলে প্রস্তরের মতো নিস্ফলা তা উদ্ধার করলেন? রাম তো কৃষকের আদি পিতা সীতা তাঁর পত্নী। সীতা মানে তো লাঙ্গলের ফলাও।

এরপরে এলেন অষ্টম অবতার কৃষ্ণ বলরাম। কৃষ্ণ হলেন রাখাল গরু চড়ান, আর বলরামের কাধে লাঙ্গল। প্রানী দিয়ে হাল চাষের শুরু। কৃষি পেলো পূর্ণতা।

জীবনের আর খাদ্যের যুদ্ধ শেষ এরপর এলেন নবম অবতার বুদ্ধ তিনি অহিংসার বানী শুনালেন, নির্বাণের বানী শোনালেন।

তাহলে কি ঈশ্বর মানুষেরই ইতিহাস? মানুষের মানুষ “হয়ে ওঠার” ইতিহাসকে ঈশ্বর অবতার হিসেবে ধারন করে আছেন?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter