স্বাস্থ্য অর্থায়নের পদ্ধতিতে একটি দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি আর জাতীয় মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে।
সারা পৃথিবীতে মোট চারটা ডমিন্যান্ট মডেল আছে যা দিয়ে স্বাস্থ্য অর্থায়ন হয়। বাকিগুলো এগুলোর বিভিন্ন মাত্রায় বিন্যাস এবং সমন্বয়।
১/ বিসমার্ক মডেল
এই মডেলে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী এবং অর্থায়নকারি প্রতিষ্ঠান উভয়েই প্রাইভেট মানে ব্যক্তি মালিকানায়। প্রাইভেট স্বাস্থ্য বীমা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য খরচ বহন করে।চিকিৎসক ও হাসপাতাল সব কিছু ব্যক্তি মালিকানায়। স্বাস্থ্য বীমার খরচ বহন করে যৌথভাবে চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান এবং চাকুরে স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানি গুলো কোন মুনাফা করতে পারেনা এবং কাউকে বীমার আওতায় আনতে অস্বীকার করতে পারবে না। জর্মনি, জাপান, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড এবং ল্যাটিন অ্যামেরিকার কোন কোন দেশে এই মডেল অনুসরন করা হয়।প্রুসিয়ান চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্কের নামেই এই মডেলের নামকরন হয়েছে।অটো ভন বিসমার্ক ই পৃথিবীতে প্রথম সকল নাগরিককে স্বাস্থ্য সেবা দেবার মডেল তৈরি করেন।
২/ বেভারেজ মডেল
এটা ইংল্যান্ডের এন এইচ এসের মডেল। এখানে সমস্ত স্বাস্থ্য সেবা ফ্রি। কাউকে কোন মেডিক্যাল বিল দিতে হয়না। স্বাস্থ্য বীমাও করতে হয়না।স্বাস্থ্য অর্থায়নের টাকাটা আসে সরাসরি কর আদায়ের মাধ্যমে। এখানে সরকারই ও বেসরকারি উভয় ধরণের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান আছে।বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে থেকে দেয় সেবার মূল্য পায়। সরকার যেহেতু পূর্ণ অর্থায়ন করে তাই সরকার নির্ধারণ করে দেয় কোন সেবার মূল্য কত হবে।ইংল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, স্ক্যেনন্ডেনেভিয়ান দেশগুলো, হংকং এই মডেলে চলে।
৩/ ন্যাশন্যাল হেলথ ইন্সিউরেন্স মডেল
এই ব্যবস্থা বিসমার্ক মডেল আর বেভারেজ মডেলের সমন্বয়।স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট বা বেসরকারি কিন্তু অর্থায়ন করে সরকার সকল নাগরিকের কাছে থেকে জাতীয় স্বাস্থ্য বীমার ইন্সিউরেন্স সংগ্রহের মাধ্যমে।ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, দক্ষিন কোরিয়া এই মডেল অনুসরন করে।
৪/ আউট অব পকেট মডেল
যে সেবা নেবে খরচ সম্পূর্ণই তাঁর নিজস্ব। কেউ এর দায় নেবেনা। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা এই মডেলের মধ্যে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এই মডেল অনুসরন করে।
পৃথিবীর সবচেয়ে ইনেফিসিয়েন্ট স্বাস্থ্য অর্থায়ন হচ্ছে অ্যামেরিকায়।যেখানে প্রতি বছর ২০ হাজার মানুষ মারা যায় শুধু ডাক্তার দেখানোর খরচ জোটাতে পারেনা জন্য।এক পিকিউলিয়ার স্বাস্থ্য অর্থায়নের ব্যবস্থা আছে তাঁদের।যেমন ৬৫ বছরের নিচের কর্মজীবী মানুষের জন্য যেটা আছে সেটাকে বিসমার্ক মডেল বলা যেতে পারে।
- আর্মির জন্য বেভারেজ মডেল।
- ৬৫ বছরের উপরে যারা তাঁদের জন্য ন্যাশন্যাল হেলথ ইন্সিউরেন্স মডেল।
- আর বাকি সাড়ে চার কোটি মানুষের জন্য আউট অব পকেট মডেল। যারা আসলে কোনদিন ডাক্তারের চেহারা না দেখেই মারা যায়।
ওবামা কেয়ার এত হইচই করে এর মধ্যে ১ কোটি ৩০ লক্ষ নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পেরেছে। কিন্তু বাকি থেকে গেছে আরো ৩ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ।আরেকটি কম্পোনেন্ট যেটা আমেরিক্যান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সর্বনাশী করে তুলেছে সেটা হচ্ছে সেখানকার ইন্সিউরেন্স কোম্পানিগুলো মুনাফা করা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তাই ৬৫ বছরের নিচের কর্মজীবী মানুষের জন্য যেটা আছে সেটাকে ঠিক বিসমার্ক মডেল বলা যায়না অ্যামেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এতই খারাপ যে স্বাস্থ্য সেবায় ন্যায্যতার সুচকে তারা বাংলাদেশের চাইতেও পিছনে।
আর বাংলাদেশ? আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম দরিদ্র মানুষের জন্য বেভারেজ আর আউট অব পকেট মডেল। আর মধ্যবিত্তের জন্য আউট অব পকেট মডেল। আর উচ্চবিত্তের জন্য যেকোন মডেল খোলা, কারণ তারা তো আর দেশে চিকিৎসা নেন না। তাই না?