প্রায়ই ধর্ম বাদীদের কাছে শুনে থাকি বিজ্ঞান নতুন অনেক আবিষ্কারের সুত্র ধর্মগ্রন্থে খুঁজে পেয়েছেন। আর এর প্রতিক্রিয়ায় যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবী করেন তাঁরা অট্টহাসি দেয়াকে কর্তব্য বলে মনে করেন। ধর্ম বাদীরা তাঁদের দাবীর পক্ষে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির করতে না পারায় এক শ্রেণীর মানুষের উপহাসের পাত্র হয়ে থাকেন। ধর্ম বাদীদের দাবীর অনেকটা গ্রহণযোগ্য হলেও অন্তর্গত অন্বেষণে তাঁদের দুর্বলতা থাকায় গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারেন না। আবার ধর্ম বিষয়টা কী এবং সেটা কোন প্রশ্নের উত্তর খোজে কী নিয়ে আসলে ধর্ম ডিল করে সেটার ধারণা না থাকায় স্যেকুলার নামধারীদের অট্টহাসি এক ধরণের মূর্খতা।
এই বিষয়ের গভীরে যাওয়ার জন্য আমাদের ধর্মের কাজ কী সেটার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। ধর্ম শুধু ঈশ্বরের বন্দনা করার নির্দেশনাই নয়, প্রত্যেক ধর্মের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে দর্শন চিন্তা। দর্শন কী নিয়ে কাজ করে? বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ে আমরা সকল মানুষ সাধারণ ঐক্যমতে পৌছাই। যেমন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে আবর্তিত হয়। আবার পৃথিবীতে এমন অনেক প্রশ্ন আছে যে বিষয়ে বিজ্ঞান বা জ্ঞানের অন্য কোন শাখায় ঐক্যমত এখনো হয়নি বা হওয়া সম্ভব নয়। যেমন ধরুন মানব জীবনের লক্ষ কী? ন্যায় কী, ন্যায় বা ন্যায্যতা কীভাবে নিশ্চিত হবে? গণতন্ত্র কি আমাদের জন্য সঠিক ব্যবস্থা? এসব বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোন ঐক্যমতে আমরা পৌছাতে পারিনি। এই ঐক্যমতে পৌছাতে না পাড়ার বিষয়গুলো নিয়েই দর্শন কাজ করে। ন্যায় কী? এটা নিয়ে সক্রেটিস যেমন অনুসন্ধান করেছেন, তেমন তার পরে দুই সহস্র বছর পার করে দিলেও আমরা এই বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছায়নি। তাই আজকে রলসকেও এ বিষয়ে আজকে আলাপ চালিয়ে যেতে হয় এবং আমরা এখনও ঐক্য মতে পৌছাতে পারিনা। আবার যখন সূর্য এবং পৃথিবীর আবর্তন কেন হয় সেটা মানুষ জানতো না তখন সেটা দার্শনিক আলোচনার বিষয় ছিল। তাই ধর্ম সেটাকে অর্থাৎ সূর্য চন্দ্রের আবর্তন নিয়ে নিয়ে ডিল করেছে, এবং তার নানা ব্যাখ্যা হাজির করার চেষ্টা করেছে। সেটা ভুল হয়েছে নাকি শুদ্ধ হয়েছে সেটা অন্য প্রশ্ন কিন্তু সেই প্রশ্ন গুলোর ফয়সালার চেষ্টা করেছের ধর্ম ও দর্শন। মনুষ্য প্রজাতির চিন্তার অনৈক্যের জায়গাই দর্শনের এলাকা। চিন্তার ঐক্য হলে সেটা দর্শনের সীমানা ছাড়িয়ে বিজ্ঞানের এলাকায় প্রবেশ করে।
ধর্মও চিন্তা করেছে, দার্শনিক অনুসন্ধিৎসা করেছে, সৃষ্টির রহস্য জানতে চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞান যে অনুসন্ধিৎসার জবাব খুঁজে পেয়েছে সেটা নিয়ে দর্শন মাথা ঘামিয়েছে এক সময়। তাই ধর্ম ও সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে একসময় অবশ্যই। ধর্মের দর্শনে সেই চিন্তার সুত্র, অনুসন্ধিৎসার আছেই, থাকাই স্বাভাবিক। সৃষ্টির রহস্যের চিন্তার সুত্র যদি ধর্মে গ্রথিত থাকে তাহলে সেটাকে অস্বাভাবিক বলার কোন কারণ নেই। মানুষের অনেক অনুসন্ধিৎসার শুরু দর্শন ও ধর্মে এবং শেষ হয়েছে বিজ্ঞানে। বিজ্ঞানের ভাষায় বললে দর্শন নাল হাইপোথিসিস উপস্থাপন করেছে আর বিজ্ঞান সেটা অপ্রমাণ করেছে। নাল হাইপোথিসিস প্রমাণিত হলেই সেটা অপবিজ্ঞান হয়ে যায়না বা বিজ্ঞানের সীমানা অতিক্রম করে যায়না। একটা উদাহরণ দেই।
হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ উপনিষদ, যা আসলে হিন্দু ধর্মের মুল দর্শন ধারণ করে তা অনুসারে। ঈশ্বর সর্বব্যাপী এমনকি ধূলিকণার মধ্যেও ঈশ্বর আছেন। সব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের উপস্থিতি ঘটে তার মধ্যে আত্মা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে। এই সৃষ্টিতে যে প্রাণ আছে তাঁর আছে আত্মা। এই আত্মার মাধ্যমে ঘটে স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ। উপনিষদের মতে প্রকৃতি প্রাণময়। ধুলিকনায় যেহেতু ঈশ্বর আছেন তাই ধুলিকনায়ও প্রাণ আছে। এই উপনিষদের ভারতবর্ষে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু যদি গাছের মধ্যে প্রাণীর অনুভুতি খুঁজতে যান সেটার পিছনে কি উপনিষদের এই চিন্তার অবদান নেই? অবশ্যই আছে কারণ আর অন্য কোন সভ্যতা তো গাছের প্রাণী সদৃশ অনুভুতির প্রমাণ খুঁজতে গেল না। প্রাণী সদৃশ অনুভুতির প্রমাণ খুঁজতে গেল একজন বাঙালি যিনি ব্রাহ্ম সমাজের ঘনিষ্ঠ এবং তখনই যখন ব্রাহ্মদের মাধ্যমে উপনিষদ বাঙলায় আবারো পঠিত হচ্ছে বিপুলভাবে। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর উদ্ভিদের অনুভুতি খোজার কাজটি এতো জরুরী মনে হয়েছে কেন যেটা পশ্চিম জরুরী মনে করেনি? কারণ ভারতীয় অনুসন্ধিৎসায় এ সংক্রান্ত যে ইশারা ছিল সেটা পূর্ণতার চেষ্টা করেছে। এবং পরিশেষে পূর্ণতা পেয়েছে একজন বাঙালি বিজ্ঞানির হাত ধরেই।
প্রকৃতিকে প্রাণময় ভাবার ধর্মের যে দর্শন চিন্তা করেছে সেটা তো আংশিকভাবে সত্যের খুব কাছেই, বিজ্ঞান তো সেটাই প্রমাণ করলো। ধুলিকনায় প্রাণ পাওয়া যায়নি ঠিকই কিন্তু যেই গাছকে প্রাণী সদৃশ অনুভূতিহীন মনে করা হতো সেটায় তো প্রাণের অনুভুতি খুঁজে পেল এই বাঙালি বিজ্ঞানী। ধুলিকনায় প্রাণ পাওয়া যায়নি জন্য যেমন ধর্ম বামন হয়ে যায়না, তেমন উপনিষদে প্রকৃতিকে অনেক আগেই প্রাণময় বলা হয়েছে জন্য বিজ্ঞান ও বামন হয়ে যায়না।
আমরা নিশ্চয় এখন বুঝতে পারছি, ধর্মের দাবিটির সারবত্তা নেই তা নয়; বরং ধর্মের দাবীকে যারা অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে তাঁদের দিকে তাকিয়ে তাঁদের চিন্তার দীনতার জন্য আমরাই এখন একটা পাল্টা অট্টহাসি দিতে পারি।