সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথে বইতে পড়েছিলাম বাঙলার সাধক ভাবুকদের যাদের আমরা বাউল ও ফকির বলে অভিহিত করি তাঁদের খাদ্য ও অখাদ্য বিচারের একটা বিশেষ নিয়ম আছে। সাধকেরা খাওয়াকে বলেন “সেবা”। সুধীর চক্রবর্তী এক সাধকের সাথে আলাপের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, সাধকেরা মনে করেন, খাদ্যের সাথে সাধকের অন্তর্গত ভাবের একটা সম্পর্ক আছে। খাদ্যের স্বভাব খাদকে সঞ্চারিত হয়। পশ্চিমে বলা হয় ইউ আর ওয়াট ইউ ইট। এটা তো বাঙলার ভাবুকদের কথা।
সুধীর চক্রবর্তীর বইয়ের সেই আলাপে বলা হয়েছিল সাধকেরা সাধারণত সব্জি পছন্দ করেন এবং পশু মাংস খাদ্য হিসেবে পরিহার করেন। এই বিচারের কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, পশুদের লজ্জা নেই, তারা প্রকাশ্যে মিলিত হয়, মিলনের সময় সম্পর্ক বিচার করেনা, এমনকি মা ও কন্যার সাথেও মিলিত হয় পশুরা। তাই পশু মাংস পরিত্যাজ্য। মাছ খান সাধকেরা। মাছের যৌনতা অঙ্গ কেন্দ্রিক নয় তাই।
বাঙলার চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস নিয়ে আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি। এই কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই সাধকদের নিজস্ব জীবন প্রণালী নিয়ে জানার প্রয়োজন হল, বিশেষ করে তাঁদের খাদ্যাভ্যাস। বাঙলার সাধকেরা সাধারণত দীর্ঘায়ু হন, লালন শাহ্ শতায়ু ছিলেন। তাঁদের জীবন চর্চায় বাঙলার লোকায়ত এবং বিশেষ করে নিম্নবর্গের সুস্বাস্থ্য চর্চা গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। সেটা জানার জন্যই গত পরশু ফরহাদ মজহার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। আরও একটা সুবিধা আছে ফরহাদ ভাই শিক্ষায় একজন ফার্মাসিস্ট তাই এই বিষয়ে তাঁর মতো রিসৌর্স পাওয়া সম্ভব নয়। উনার সাথে আলাপচারিতা থেকেই বাকি অংশটা লিখে রাখার তাগিদ অনুভব করি। ফরহাদ ভাই খাদ্য অখাদ্য বিচার নিয়ে সুধীর চক্রবর্তীর বইয়ের কথাগুলো বললেন, আরও নতুন কিছু যুক্ত করলেন। সেটায় যাওয়ার আগে জানালেন, লালন আয়ুর্বেদ চর্চা করতেন, লালনের কাছে একটা বই ছিল, নাম আয়ুর্বেদ কৌমুদী; সেটা উনি পড়তেন। লালন শাক-সব্জির পাশাপাশি ইলিশ মাছ পছন্দ করতেন, ফলমূল পছন্দ করতেন। তবে সাধকেরা যে একেবারে মাংস খান না সেটা নয়। যদি কেউ সাধককে নিমন্ত্রণ করে সাধকের পছন্দের বিষয়টা না জেনেই ভুলে খাবার বা সেবা হিসেবে মাংস পরিবেশন করেন তবে সাধক সেই মাংস খাবেন, কারণ সাধককে তো সেই খাবার ভক্তি আর ভালবাসার সাথে পরিবেশন করা হয়েছে। সাধক তো শুধু খেতে যাননি সেখানে তিনি তো প্রেমের কাঙাল, তাই সেই খাবার যার সাথে প্রেম আর ভক্তি যুক্ত হয়ে আছে সেটা তিনি খাবেন। এছাড়া এমন অঞ্চল তো পৃথিবীতে আছে যেখানে মাংস না খেলে প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়। সেখানে একজন সাধক কী করবেন?
আর পরিশেষে ফরহাদ ভাই বললেন, সাধক চান তাঁর খাবার যেন আগুনের স্পর্শ না পায়। কারণ সাধক মনে করেন তাঁর পাকস্থলীতেই সাঁই আগুন দিয়েছেন খাবারকে দহন করার জন্য। পাকস্থলি যদি কোন খাবারকে দহন না করতে পারে তাহলে আলাদা করে সেই খাবার বাইরে আগুনে রান্না করে খাওয়া উচিৎ নয় সাধকের। রান্না না করে খাওয়া যায় এমন খাবার কী কী আছে? অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করবেন যেই সমস্ত খাবার স্বাস্থ্যকর বলে চিহ্নিত সেই সমস্ত খাবারই আগুনের স্পর্শ হীন। যেমন।
১/ গ্রীন সালাদ।
২/ ছাতু
৩/ ওট
৪/ দই
৫/ মাখন
৬/ চীজ
৭/ ফলমুল।
৮/ ফলের রস।
৯/ ম্যারিনেইট করা কাঁচা মাছ।
১০/ স্বল্প পরিমানে মদ্য জাতীয় পানীয় ( যা নেশা উদ্রেক করেনা, শুধু ক্যালরি যোগায়)
১১/ মধু
১২/ আখের রস/খেজুরের রস
১৩/ বাদাম
১৪/ দুধ/ ছানা
আমাদের খাদ্য আর অখাদ্য বিচারে কী পশ্চিমের পরামর্শ শোনার দরকার আছে? বাঙলার ভাবসম্পদে এমন কত মনিমুক্তা যে লুকিয়ে আছে কে তাঁর খোঁজ নেয়? YOUR BODY IS FINELY TUNED VEHICLE, GIVE IT GOOD FUEL, IT WILL TAKE YOU PLACES বাঙলার ভাবুকেরা যদি ইংরেজিতে বলতেন তাহলে হয়তো আমরা শুনতাম মন দিয়ে।