আমি কেন বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম সমস্যা নিয়ে লিখি? একটা কৈফিয়ত।

কয়েকদিন আগে আমার লেখায় একজন কমেন্ট করে বলেছেন আমি এইসব হিন্দু মুসলিম সমস্যা নিয়ে লিখি কেন? আমি কী হিন্দু বা মুসলিম কোন সম্প্রদায়ের নেতা?

জ্বিনা ভাই। আমার কোন সম্প্রদায়ের নেতা হওয়ার খায়েশ নাই। আমি রাজনীতিকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভাগ করি না, ভাগ করতে চাই না। করা ঠিকও মনে করি না। ফলে হিন্দু ইস্যুতে কথা বলার অধিকার কেবল হিন্দু নেতারই। আর মুসলমানদের বিষয় কেবল মুসলমান নেতারই হতে হবে; এই ভাগ করাকে আমি বিপদজনক মনে করি। আমি সাম্প্রদায়িক মানুষ নই। কোন সম্প্রদায়ের এমন “নিজস্ব সংগঠন” থাকাই সাম্প্রদায়িক। সেটা যদি নিপীড়িত সম্প্রদায়ের হয় তাও সেটা সাম্প্রদায়িক। দেশের নাগরিক হিসেবে আমার চিন্তা ব্যক্ত করার পুর্ণ অধিকার আমার আছে। আর হিন্দু মুসলিমের বিভেদাত্মক অবস্থা যদি দেশের সামগ্রিক অবস্থাকে আরও সংকটে ফেলে; আর কেউ সেটা নিয়ে কোন কথা বলতে চাইলে তাকে চুপ করে থাকতে বলাটা দুরভিসন্ধিমুলক।

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় এক জটিল সময় অতিক্রম করছে নানা অর্থেই। তাঁদের উপর সহিংসতা বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশী। সন্দেহ নেই। সেটা মাত্রায় এবং বৈচিত্র‍্যে অভুতপুর্ব। এখন এই সমস্যার সমাধান কী?

হিন্দুরা নিপীড়িত হিসেবে তাঁদের সংগঠন করেছে এবং তাঁদের হিন্দু পরিচয়ের মধ্যে থেকেই এই সমস্যার সমাধান খুজছে। কারণ তারা মনে করেছে হিন্দুর সমস্যায় একমাত্র হিন্দুরাই দাড়াতে পারে। এই অনুমান সেক্টোরিয়ান অর্থে সাম্প্রদায়িক ও বিভেদাত্মক এবং সর্বাংশে ভুল। এই কারণেই তারা বিভেদাত্মক একটি সংগঠন দিয়ে তাঁদের উপর চলা বিভেদাত্মক নিপীড়নের কোন সমাধান করতে পারছেনা বা খুজে পাচ্ছেনা। তাই তাঁদের সাত দফা দাবীর প্রথম দাবীই হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক দাবী। তারা দাবী করেছে; সংখ্যালঘুদের জন্য সংসদে ৬০টি আসন সংরক্ষণ করা; প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিটি স্তরে ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের পদায়ন। এই কথার সোজা অর্থ তারা বাংলাদেশকে একটা একক রাষ্ট্র হিসাবে রেখে নাগরিক হিসেবে সমাধান চায় না। নাগরিক পরিচয়কে ভেঙ্গে সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলে হিন্দুদের জন্য ভেঙে ভেঙে রাষ্ট্রের আলাদা হিস্যা চায়।

ধর্ম পরিচয় ছাড়াও সমাজে অসংখ্য বিভেদ থাকে। এই বিভেদের উপরে উঠে আমরা এক পলিটিক্যাল কমিউনিটি তৈরি করি যেটাকে রাষ্ট্র বলে। হিন্দু বা মুসলমানের রাষ্ট্রচিন্তায় যদি রাজনৈতিক বিভেদগুলোই প্রধান করে তোলা হয়, নিরসনে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নিবার উপায় না থেকে থাকে, প্রস্তাব না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে রাষ্ট্র গঠনের গোঁড়ায় কোন গলদ আছে। ফলে নতুন রাষ্ট্র সেখানে সম্ভব না। অথবা আর আগে থেকে হয়ে থাকা রাষ্ট্র থাকলে সে রাষ্ট্রও টিকবে না তা আগেই বলা যায়।

রাষ্ট্র গঠন মানে রাজনৈতিক সমাজ তৈরি যেই রাজনৈতিক সমাজে সকল নাগরিক তার সাম্প্রদায়িক পরিচয় নয়, নাগরিক পরিচয়ে অংশ নেবে। সেই রাজনৈতিক সমাজ বা পলিটিক্যাল কমিউনিটি বা রাষ্ট্র গঠনের কাজই আমাদের আশু কর্তব্য।

হিন্দু সম্প্রদায়কেও এই পলিটিক্যাল কমিউনিটি গড়ার কাজে অন্য সকলের সাথে মিলে অংশ নিতে হবে, হাত লাগাতে হবে। পলিটিক্যাল কমিউনিটি বিষয়টার রাজনৈতিক ও সামাজিক গভীরতা বুঝে কাজ করতে হবে। আর সর্বোপরি তার নাগরিক পরিচয়কে মুখ্য করতে হবে বা উর্ধে তুলে ধরতে হবে।

“আমরা হিন্দু, আমাদের উপর মুসলমানেরা অবিচার করছে।” এমন ভাষায় অভিযোগ কেউ করতে পারে। কিন্তু আমি হিন্দু হিসাবে এর সমাধান চাই, হিন্দু কায়দায় চাই, হিন্দুদের আলাদা কোটায় চাই এভাবে আমরা বলতে পারি না। এভাবে বললে তখন সেই নালিশ সাম্প্রদয়িক বা বিভেদমুলক নালিশ হবে। এবং প্রত্যাশিত সমাধান হবে সাম্প্রদায়িক সমাধান। যার উদ্দেশ্য যাই হোক পরিণাম ভাল না। কারণ এই ধারার নালিশের মানসিকতাটাই বিভেদাত্মক। অথচ বাস্তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল নালিশ, অভিযোগ এই অবস্থানের উপর দাড়িয়ে। এই অবস্থান কোন সমাধান দিতে পারবেনা। ইন ফ্যাক্ট পারছেও না। আবার অবাক বিষয় হচ্ছে তার নিজের সমস্যার সাম্প্রদায়িক সমাধান চাইলেও সে ঘোষণা করে যে সে চায় একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক সমাধান দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কীভাবে সম্ভব হতে পারে কেউ বুঝিয়ে বলবেন কী?

হিন্দু সম্প্রদায়কে বলতে হবে, “আমি এই দেশের নাগরিক, এবং আসেন আমরা এমন একটা রাষ্ট্র গড়ে তুলে যেই রাষ্ট্রে বিভেদাত্মক আচরণের শিকার হওয়ার কোন বস্তুগত শর্ত উপস্থিত থাকবেনা।“

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় কি এই জরুরী কাজ করতে রাজী আছে?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter