বাংলাদেশের “হিন্দু মন” ও তার বিবর্তন

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় নানা ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে গেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা কষ্ট বঞ্চনা, অভিমান আর দুঃখের ইতিহাস ছাড়াও তার সাথে আছে অনেক ভুল-শুদ্ধ সিদ্ধান্ত এমনকি রাজনৈতিক বোকামি। আর এসব কিছুর উপরে আছে নানা রাজনৈতিক অভিঘাত যা বর্তমানের হিন্দু মানসকে তৈরি করেছে। তাই এই হিন্দু মানস সবসময় একই রকম ছিলনা। এর নানান চড়াই উতরাই আছে, বাঁক আছে। এইসব ঘিরেই আজকের হিন্দু মানস তৈরি হয়েছে। তাই হিন্দু মানসের একটা নির্মোহ আলোচনায় এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলির অভিঘাত বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই আলোচনা শুরু করার কোন বিকল্প নাই। এই আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। এই গুরুত্তপুর্ণ রাজনৈতিক পর্যালোচনা থেকেই বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতের উত্তরণের পথ।

হিন্দু মানস পরিবর্তনের প্রথম গুরুত্বপুর্ণ এবং নতুন আকার নেয়ার ঘটনাটা ঘটে ৪৭ এর দেশ ভাগের সময়। দেশভাগের সাথে সাথে পুর্ব বঙ্গে জমিদারি শাসন কার্যত উচ্ছেদ হয়ে যায়। হিন্দু সম্প্রদায় হারায় তাঁর একচেটিয়া রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি। ব্যাপক হারে দেশ ত্যাগের ঘটনা ঘটে। থেকে যায় যারা তারাই আজকের বাংলাদেশী হিন্দুদের পুর্বসুরী; হিন্দু মানস সম্পর্কে আমার প্রসঙ্গ এই থেকে যাওয়া হিন্দুদের বিষয়ে। ‘৪৭ কে ঘিরে দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের দাঙ্গা কেন হয়েছিল? তা যে কারণেই হোক, এই বিষয়টা যে কোন রাজনৈতিক দল, বা ধর্মের অনুসারি সবার কাছেই এক অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ হয়ে আছে। বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায় রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যে যেভাবে লড়েছিল কেউই অন্তত আশংকা করে নাই যে একটা পারস্পরিক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। ফলে বাইরে বলার জন্য দুপক্ষের আলাদা বয়ানে যাই থাক না কেন; যে কোন রাজনৈতিক পক্ষই একান্তে নিজের কাছে বলবার মত এর কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির করাতে পারেনি।

হিন্দু সম্প্রদায়ও হয়ে পরেছিল বিহ্বল; সামাজিক সন্মান, সম্পদ, জমিদারি, দেশ হারিয়ে সব দায় চাপিয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর এবং তার আচরিত ইসলাম ধর্মের উপর। আর সবার উপরে মনের গভীরে লালন করেছিল এক অনুমান যে, ধর্মই তার দেশ বিভাগ ঘটিত সব দুর্দশার মূল। কিন্তু শুধু “মুসলমানের ধর্মটা সমস্যা” একথা বলা যায় না বলে বলবার সময় সাধারণভাবে ধর্মবিহীন বা নিধর্মী এক সমাজের অনুমান সে হাজির করেছিল।

দেশভাগের পরে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির হারানোর মানে সাথে সাথে হিন্দুদের সব পুরান বয়ানও হারিয়ে অকেজো হয়ে যায়। তাই নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য সে নতুন বয়ান গঠনের সন্ধানে নামে। আর নিধর্মী এক সমাজের অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে সেই নতুন বয়ানটা সে হাজির করেছিল যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সে হল কমিউনিস্ট পার্টি বা এর নাম আজকের সিপিবি। বিহ্বল অবস্থা কাটানোর জন্য সে আশ্রয় করেছিল কমিউনিস্ট পার্টিকে। পুর্ব বঙ্গে থেকে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জমিদারি হারানো পুরনো জমিদার বংশের ছেলেরা ও অভিজাত হিন্দু মধ্যবিত্তরা এই পার্টিতে দলে দলে ঢুকতে থাকে। কমিউনিস্ট রাজনীতির কয়েকজন আইকনকে দেখলেই এই কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। কমরেড মনি সিংহ, বরুন রায়, ইলা মিত্র, রবি নিয়োগী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অমল সেন, গুরুদাশ তালুকদার, ধীরেন শীল সহ আরো অসংখ্য নেতার নাম করা যায়, যারা সকলেই প্রত্যক্ষ ভাবে জমিদার এবং একজন নায়েব পরিবারের সন্তান।

পরবর্তিতে ১৯৫১ সাল থেকে পাকিস্তানে ঘটা ব্যর্থ সামরিক ক্যু এর পরিকল্পনার কারণে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হিন্দু মধ্যবিত্তের এক বড় প্রভাব ছেয়ে বসতে থাকে কমিউনিস্ট পার্টিতে। সে সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপক ভাবে সিপিবি করার করার পিছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণ এটাই। সারকথায় বললে, সেই থেকে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় ভেবে এসেছে যে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে তার পোষা বিদ্বেষ বিরাগ সেটার একটা ফয়সালা হতে পারে এভাবে যে, “আমরাও দরকার হলে নাস্তিক হয়ে যাই তবুও যদি কমিউনিস্ট হওয়ার বদৌলতে মুসলমান সম্প্রদায় নাস্তিক হয়েও তার ধর্ম থেকে দূরে সরে তাহলে তো লাভই”। পুর্ববঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিতে নাস্তিকতার ব্যাপক চর্চার এটাও একটা সাম্ভব্য কারণ।

এই ধারা চলে ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার সময় পর্যন্ত। ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক ভাঙ্গনে ও ১৯৯২ সালের সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পরে দুবারই বাংলাদেশের হিন্দুদের বড় অংশই পুনর্গঠিত সিপিবি ঘরানার পক্ষেই থেকে যায়। যদিও পরেরটার ক্ষেত্রে সক্রিয়তার দিক থেকে ব্যাপক হিন্দু হতাশ হয়ে দূরে চলে যায়। তাই এরপরের সময়, ১৯৯২-২০০১ সাল পর্যন্ত এই কয়েকটা বছর ছিল সিপিবির ক্রমাগত ক্ষয়ের যুগ। আর হিন্দু সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে এতদিন যেভাবে সিপিবির মাধ্যমে বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত থাকত সেটা থেকে হতাশা ও ক্রম প্রস্থানের যুগ। যদিও অসাম্প্রদায়িকতার নামে তার ইসলাম –বিদ্বেষী অবস্থান সব খানেই ছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়াতে গ্লোবাল কমিউনিজমের আড়ালে ধর্মবিদ্বেষ বা ইসলামবিদ্বেষ চালানোর সুযোগ আর থাকেনা।

তারপর আসলো ২০০১ সালের নাইন ইলেভেন। শুরু হল বুশ ব্লেয়ারের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ এর কাল। এইবার হিন্দু সম্প্রদায় যেন ফেটে পড়ার সুযোগ নিল। ইসলাম সম্পর্কে তার মনের গহীনে পুষে রাখা বয়ানের সাথে তারা বুশের বক্তব্যের মিল খুঁজে পেল। বাংলাদেশের হিন্দুরা ব্যাপারটাকে দেখলো এভাবে যে; সে যাদের হাতে মার খেয়েছে এতদিন, এইবার আমেরিকার মত পরাশক্তি নেতৃত্বে সেই ইসলামের বিরুদ্ধে এক বৈশ্বিক লড়াই শুরু হয়েছে। সে আকাঙ্খা করলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ছাপ বা আঁচ নিশ্চয় এদেশেও এসে পড়বে। সে আমেরিকাকে বুঝাতে চাইল যে; এই কস্ট তো আমারও, এই আমরাই তো এই সম্প্রদায়ের হাতে সেই ৪৭ সাল থেকে মার খেয়ে আসছি। বৈশ্বিক ভাবে এরা যদি শায়েস্তা হয়ে যায় তাহলে তো ভালোই হয়, ফলে বুশের পক্ষে তার ঝাপিয়ে পড়ে সমর্থন দেয়া উচিত। হিন্দুরা হয়ে উঠলো “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের” প্রজেক্টের একনিষ্ঠ সমর্থক। এজন্য এই পর্যায়টাকে বলা যেতে পারে আমেরিকার কোলে চড়ে হিন্দুদের সিপিবি থেকেও দূরে চলে যাওয়া, বা অনাস্থার প্রস্থান।

এর মাঝে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক রাজনীতির উত্থান ঘটলো। ততদিনে বুশের বদলে ওবামা আসে অ্যামেরিকায়, অকেজো হয়ে পরা ওয়ার অন টেররের সংশোধনও আসে র‍্যান্ড প্রজেক্টের মাধ্যমে। কিন্তু শেখ হাসিনার ওয়ার অন টেররের নীতি চলতেই থাকার কারণে বাংলাদেশের হিন্দুরাও এর মধ্যে নতুন আলো সঞ্চারিত হয়েছে দেখে সদলবলে আরো বেশি করে নব উদ্যমে আওয়ামী লীগের একনিষ্ট সমর্থক হয়ে উঠে। নতুন আশায় তারা বুক বাধে। যদিও এর ফলাফলে ইসলাম বিদ্বেষ আরও সবল হওয়া ছাড়া কোন ফল নাই।

ওদিকে ২০১৪ সালে ভারতে ক্ষমতায় উত্থান ঘটলো বিজেপির। এছাড়া এবছর কলকাতাতেও প্রাদেশিক নির্বাচন হয়ে গেল। আর শুরু হল বিজেপির আগামি কলকাতা দখলের পরিকল্পনা। আগামিতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে জিততে হবে সেই কৌশলের অংশ হিসাবে (মুসলমানের) বাংলাদেশকেও ব্যবহার করা , বা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাই এবার বিজেপির রাজনীতির প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের একাংশের মধ্যে এই প্রথম প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে বিজেপি ও তার মতাদর্শ। ইসলামের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ সাথে এবার “হিন্দুত্তবাদ” যোগ ঘটলো বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। একদা প্রগতিশীলতার সাথে থাকা একটি সম্প্রদায় ক্রমশই হয়ে উঠেছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি।

কিন্তু এই একাট্টা বিভেদকামী বিদ্বেষ হিন্দু সম্প্রদায় পুষে রেখে কি আদৌ সে নিজ সম্প্রদায়ের উপকার করছে? নাকি এই বিদ্বেষ আরো এক দীর্ঘমেয়াদী যন্ত্রণার উন্মেষের পথ করে দিচ্ছে ও দিবে? এই দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্মোহ দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter