বাংলাদেশে “সাম্প্রদায়িক” শব্দটা কেন গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়?

এটা খুব কৌতুহলউদ্দিপক প্রশ্ন। সম্প্রদায়ের সাথে থাকা, মিশে থাকা, সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা অনুভুতি থাকা কোন নেতিবাচক কিছু না। ফলে অরিজিনালি নিজ সম্প্রদায়ের সাথে থাকা অর্থে সেখান থেকে ‘সাম্প্রদায়িক’ একটা ইতিবাচক শব্দ। ঠিক যেমন ইংরাজিতে কমিউন বা কমিউনিটি শব্দটা খুবই ইতিবাচক শব্দ। কোন ডেরোগেশন বা ডেরোগেটরি শব্দও অর্থ নয় এটা।

বাঙলা ভাষাভাষীদের কাছে ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটাকে গালি হিসেবে ব্যবহার চালু করে তোলার কৃতিত্ব হিন্দুদের। এটা হিন্দুদের মুসলমানদেরকে গালি দেয়ার জন্য একটা আবিষ্কৃত শব্দ। এমনভাবে শব্দটা ব্যবহার করা হয় যেন এটা শুনতে শোনায় এমন, “তুই ব্যাটা মুসলমান”।

এককালে তাই এই শব্দটা কিন্তু পজিটিভ অর্থেই ব্যবহার করতো হিন্দুরাও। ১৮২৭ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দর্পন পত্রিকায় একজন সম্পর্কে ভালো কথা বলার জন্য লেখা হচ্ছে,

“সাম্প্রদায়িক মর্য্যদক পরোপকারক সহনশীল মনুষ্য ছিলেন।“

এখানে সাম্প্রদায়িক শব্দটার অর্থ “আপন সম্প্রদায়ের”। সম্প্রদায়ের মানুষ বুঝাতে রবীন্দ্রনাথ ও ব্যবহার করেছেন এই শব্দটা । তিনি লিখেছেন,

“য়ুরোপে সৌন্দর্যচর্চা সৌন্দর্যপুজা বলিয়া একটা সাম্প্রদায়িক ধুয়া আছে।“

এটা তিনি লিখছেন ১৯০৭ সালে। কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ অর্থে বিদ্বিষ্ট হিসাবে এই শব্দটার রবীন্দ্রনাথ আবার ব্যবহার করেছেন আরো পরে ১৯৩১ সালে। যেমন তিনি লেখেন,

“পিয়র্সন কয়েক জোড়া সবুজরঙের বিদেশী পাখি আশ্রমে ছেড়ে দিয়েছিলেন । অনেক দিন তারা এখানে বাসা বেঁধে ছিল । আজকাল আর দেখতে পাই নে । আশা করি কোনো নালিশ নিয়ে তারা চলে যায় নি , কিংবা এখানকার অন্য আশ্রমিক পশু-পাখির সঙ্গে বর্ণভেদ বা সুরের পার্থক্য নিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটে নি।“

সেকারণেই, প্রায় ১০০ বছর আগে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা অভিধানে “সাম্প্রদায়িক” বলে কোন শব্দ নাই। ১৯৩৪ সালে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে সাম্প্রদায়িক শব্দের অর্থ বলা হয়েছে

১/ সম্প্রদায় হইতে আগত ।

২/ সম্প্রদায় বিশেষের মতাবলম্বী।

কিন্তু আধুনা সংসদ বাঙলা অভিধানে এই সাম্প্রদায়িকতা শব্দের এইবার একটা তিন নম্বর অর্থ যুক্ত হতে দেখি তা হচ্ছে, “সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন”।

তাহলে আমরা খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম এই শব্দটাকে একটা গালি হিসেবে ব্যবহারের জন্য এখানে খুব কৌশলে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু গালিটা কাকে?

এবার দেখুন এটার প্রথম দিককার পলিটিক্যাল ব্যবহার।

১৯৩৭ সালে শেরে বাঙলা অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেঙ্গল প্রজাস্বত্ব আইনের একটা সংশোধনী বিল আনেন। সেই বিলে তিনটা সংশোধনী ছিল বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের। বলে রাখা ভালো এই বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন দিয়েই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে আমাদের পুর্বপুরুষদের জমি কেড়ে নিয়ে জমিদারি প্রথার আইনি ভিত্তি সৃষ্টি করা হয়।

শেরে বাংলার সংশোধনী গুলো ছিলঃ

১/ রায়ত যদি জমি হস্তান্তর করতে চায়, জমিদারের বাগড়া দেয়া ছাড়াই জমি স্বাধীনভাবে হস্তান্তর ও ভাগ করতে পারবে।
২/ জমিদারদের খাজনা বৃদ্ধির অধিকার রদ করা হয়।
৩/ সেলামি ও নজরানা ফি নামের জমিদারকে দেয় জমি হাস্তান্তর ফি বাতিল করা হয়।

খেয়াল করলে দেখবেন জমিদারের করতৃত্বকে ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়েছিল এই বিলে। হিন্দু জমিদারেরা এই প্রথম এই বিলকে “সাম্প্রদায়িক” বলে প্রত্যাখ্যান করে। আরে বাবা এখানে সাম্প্রদায়িকতার কী আছে? এইটা তো একটা প্রগতিশীল পদক্ষেপ। জমিদারের পেটে লাথি মেরেছে ঠিকই কিন্তু এটা “সাম্প্রদায়িক হয় কীভাবে? (সুত্রঃ বাঙলা ভাগ হল, জয়া চ্যাটার্জি, ইউপিএল, ২০১৪, পৃষ্ঠা ১২৫)

এর পরে ১৯৪৮’র ৭ এপ্রিল পূর্ব বাংলা বিধান পরিষদে জমিদারিপ্রথার উচ্ছেদের জন্য ‘পূর্ববাংলা জমিদারি ক্রয় ও প্রজাস্বত্ত্ব বিল’ উত্থাপন করা হয়। বিধানসভার নেহেরু কংগ্রেসের সদস্যরা বিলটির বিরোধিতা করেন। একজন বিধায়ক বলেন,

“স্যার, আমি এ ব্যাপারে আরো বলতে চাই যে, দুর্ভাগ্যবশত: অধিকাংশ বড় জমিদাররা হিন্দু হবার ফলে তা প্রস্তাবিত বিলটিকে একটা সাম্প্রদায়িক চরিত্র দান করবে।” [সূত্র: বদরুদ্দীন উমর, “পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি”, পৃষ্ঠা: ১৩১-১৩২]

এই কংগ্রেসি আলোকে এইবার সাম্প্রদায়িকতা আর অসাম্প্রদায়িকতা শব্দ দুইটার মর্মার্থ খুজুন। এর মর্মার্থ হচ্ছে, আমার সেই জমিদারির রুস্তমি ফিরিয়ে দাও।

স্যেকুলার বয়ানে তাই সাম্প্রদায়িকতা মানে জমিদারি কেড়ে নেয়া, আর অসাম্প্রদায়িকতা মানে হচ্ছে জমিদারি ফেরত দেয়া। অবশ্য তারা জমিদারি মানে ম্যাটারিয়াল ফর্মে জমিদারি বুঝায় না। যা বুঝায় তা হচ্ছে সেই জমিদারী শান শওকত, সামাজিক প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক প্রভাব, কালচারাল রুস্তমি এগুলা সবই।

তার মানে, হিন্দুদের তৈরি বয়ানে, চিন্তার কাঠামো এবং কন্সট্র্যাকশনের যেই বিরোধিতা করবে – হিন্দুদের সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অথরিটি করে সাজানো বাগানের অর্ডার বা শৃঙ্খলায় যে আঘাত করবে, ভিন্নভাবে সাজাতে চাইবে, নিজের ভাগ অধিকার চাইবে — স্যেকুলার এবং হিন্দুকুল তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দেবে।

লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter