পশ্চিমবঙ্গের দেয়াল লিখন নিয়ে কয়েকদিন আগে একটা কৌতুককর লেখা লিখেছিলাম। এর মধ্যে একটা বইয়ে পশ্চিমবঙ্গের দেয়াল লিখন নিয়ে একটা স্কলারলি লেখা পড়লাম। বইটার নাম “বহুরূপে ভাষা”। সেখানেই জানলাম সবচেয়ে বেশী যেই বানীটা দেয়ালে লেখা হয় সেটা হচ্ছে।

“দেয়ালে প্রশ্রাব করিবেন না, করিলে …টাকা জরিমানা।”

দেয়ালে প্রশ্রাব করে কেউ জীবনে জরিমানার টাকা গুনেছে সেটা কেউ শোনেনি তবুও জরিমানার ভয় দেখাতেই হবে। এটায় যখন কাজ হয়না তখন কেউ কেউ লিখতে শুরু করেন।

“এখানে যে প্রশ্রাব করে সে মানুষ না কুকুর”

একেবারে মনুষ্যত্ব নিয়ে টানাটানি তারপরেও সারমেয়া অপবাদ নিয়ে সবাই দিব্যি এই কর্ম করেই চলেছেন। আরেকটু ক্রিয়েটিভ কেউ এই বাক্যকেই অন্যভাবে লিখেছে;

“দ্যাখ দ্যাখ কুকুরটা মুতছে”

এ বিষয়ে সবচেয়ে অ্যাগ্রেসিভ দেয়াল লিখন ছিল এই রকম

“যে শালা এখানে পেচ্ছাব করে, সে তার মাকে………।”

বলাই বাহুল্য এই অয়িদিপাস কমপ্লেক্স কাউকেই বিচলিত করেনি এবং যথাস্থানে মুত্র ত্যাগ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।

এরপরে সবচেয়ে বেশী যেই দেয়াল লিখন হয় সেটা ভৌটের। এটা নিয়ে দাদাঠাকুর একটা চমৎকার ছড়া বানিয়েছিলেন।

“আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু- ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে”।

কমিউনিস্টরা কবির কবিতা ধার করে জোর করে ছন্দ মিলিয়ে লিখেছিল।

“শোন রে মজুতদার ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ করবো তোকে এবার।”

মজুতদারকে ফসল ফলানো মাটিতে রোপন করে মজুতদার তৈরির এই পরিকল্পনা সফল হয়েছিল কিনা জানা যায়না।

১৯৭৭ এ সিপি আই আর কংগ্রেসের ঐক্য নিয়ে লেখা সেই বিখ্যাত দেয়াল লিখন।

“দিল্লি থেকে এলো গাই সঙ্গে বাছুর সিপি আই”। এখনো মানুষ মনে রেখেছে। কংগ্রেস বনাম সি পি এম দেয়াল লিখন যুদ্ধ নিয়ে যেই লেখাটা লিখেছিলাম সেখানে একটা সংশোধনী আছে। কংগ্রেসের লেখাটা ছিল এই রকম।

“চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদম তলায় কে? হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে জ্যোতিবাবুরে বে।”

এর উত্তরে সিপিএমের লেখা

“ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ভাই। ইন্দিরাকে ছাদনাতলায় সাজিয়ে আনা চাই।”

১৯৭৭ এ কংগ্রেসের পরাজয়ের পর ৮২ তে আবার যখন ইন্দিরা গান্ধী জিতলেন। তখন উজ্জীবিত কংগ্রেস লিখলো।

“রায়বেরিলি ভুল করিলি, চিকমাগানুর করেনি; সি পি আই এম মনে রেখো ইন্দিরাজী মরেনি।”

ইন্দিরা গান্ধীর এই পুনরুত্থানের পিছনে ছিলেন তার কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। ইন্দিরাকে কটাক্ষ করে বামফ্রন্টের লেখা।

“বড়লোকের বিটিলো সাদাকালো চুল, তার বাপের কোটে গোজা ছিল, লাল গোলাপ ফুল; সেই বিটির বেটা লো-পাতলা পাতলা চুল, সব্বাইকে দেখিয়ে দিল চোখে সর্ষে ফুল”।

রাজিব গান্ধীর সময়ে ছিল বোফর্স কামান কেনার দুর্নীতির কেচ্ছা। সেই সময় লেখা হল।

“অলিগলি মে শোর হ্যায় রাজিব গান্ধী চোর হ্যায়”

আবার কেউ কেউ সরাসরি লিখলো

“জহর দাদুর নাতি তুমি ইন্দু মাসির ছেলে; বোফর্স কামান বেচার টাকা কোথায় রেখে এলে?”

পশ্চিমবঙ্গে তখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায়। চারপাশে এসে জুটছে সব সুযোগ সন্ধানী। বামফ্রন্ট আস্কারাও দিচ্ছে তাদের। সেই সময়ের বামফ্রন্টের সমালোচনায় একটা দেয়াল লিখন।

“দিনের বেলায় কৌটা নাড়ে, রাতের বেলায় ফিস্ট; ভোটের সময় এরাই বলে, আমরা কমিউনিস্ট”

১৯৯৭ এ নতুন দল তৃণমূল একটা চমৎকার ভৌটের শ্লোগান বানিয়েছিল।

“চুপচাপ, ফুলে ছাপ।“ বা “ঘাসের উপর ছোট্ট ফুল, বাংলা বাচাবে তৃণমূল’।

সেই নির্বাচনে না জিতলেও পরে সেই ঘাসফুল বাঙলার পশ্চাৎদেশে আইক্ষ্যা ওয়ালা বাঁশ হয়ে ঢুকেছে।

২০১১ সালে তৃণমূল আরেকটা চমৎকার প্রত্যয়পুর্ন শ্লোগান বানিয়েছিল।

“১৯৭৭ নং বামফ্রন্ট ডাউন লোকাল ৩৪ নং প্ল্যাটফরম ছেড়ে যাচ্ছে; ২০১১ নং মা মাটি মানুষ এক্সপ্রেস ঐ প্ল্যাটফরমে আসছে”।

এখন নানা দুর্নীতি দুঃশাসনের অপবাদ নিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায়। সাম্প্রতিক দেয়াল লিখন গুলো এইরকম।

“তৃনমূলের চৌত্রিশ মাস; মানুষের সর্বনাশ।“ অথবা
“দিদির পায়ে হাওয়াই চটি; ভাইয়েরা সব কোটিপতি”

তবে যে যাই বলুন। আজকালকার দেয়াল লিখনে সেই ঝাঝ নেই। কারণ কবিরা এখন আর সেই দেয়ালের লেখার খসড়া করে দেন না।

লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter