বাংলাদেশে যে কয়টি পেশার সাথে সাধারণ মানুষের দুরত্ব বেশী তার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে তার বা তার প্রিয়জনের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে এক বা একাধিক চিকিৎসকের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ নয়। আমিও এর বাইরে নই। আমার নিজের চিকিৎসায় আমি এই ঢাকা শহরেই কোন এক চিকিৎসকের কাছে থেকে কিছুদিন আগেই বর্ননাতীত দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছি। আমার বেশ কয়েকদিন লেগেছে সেই হেনস্থা ভুলতে।
আমি নিজে চিকিৎসক, আমার স্ত্রী একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, আমি পড়াশোনা করেছি বাংলাদেশের সরকারী মেডিক্যাল কলেজে, আমি সেই মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত জি এস ছিলাম, অনলাইনের সুবাদে আমাকে অল্পবিস্তর মানুষ চেনেন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যবসার সাথে আছি দির্ঘদিন; এছাড়া আমার বয়সও হয়েছে; তারপরেও একটা কর্পোরেট হাসপাতালে আমি মোটামুটি আমার হাটুর বয়সী এক ডাক্তারের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছি। তাহলে সেখানে আম জনতার কী অবস্থা হতে পারে আমি সেটা অনুমান করতে পারি। আমি বিনয়ের সাথে উল্লেখ করছি, ওই একটি ঘটনা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমার চিকিৎসা সংক্রান্ত আর সব অভিজ্ঞতাই ভালো; এটাই আমার জন্য স্বাভাবিক।
সাধারণ মানুষের এই বিপুল বিরাগ থাকার কারণেই উল্টো একজন ডাক্তার হেনস্থা হতে দেখলে, সাধারণ মানুষ মনে করে, উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। তার আহত ইগো তৃপ্ত হয়। এই সমস্যার সুযোগ নেয় জনবিচ্ছিন্ন সরকার। সে তার জনবিচ্ছিন্নতা কাটানোর তরিকা হিসেবে ডাক্তারদের শায়েস্তা করে সাধারণ মানুষের বাহবা কুড়ায়।
এই কারণেই বলেছি বাংলাদেশের ডাক্তারদের সামনে এখন মহাবিপদ। জনতোষনের এতো সহজ উপায় আছে যখন তখন সেটা তো ব্যবহার করবেই শাসকেরা।
কিছুদিন থেকে নিশ্চয় লক্ষ্য করছেন পাবলিক ওপিনিয়নকে যদি সেটা সরাসরি সরকার বিরোধী না হয় তাহলে সেটাকে সরকার খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। বনানীর ধর্ষনকাণ্ডই তার প্রমাণ।
ভুল চিকিৎসার অভিযোগ যদি জোরেশোরে তোলা যায় তাহলে পটাপট সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের কোমরে দড়ি পরানো হবে, আমার আশংকা এটাই। এরপরে হয়তো কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে যাবে, তখন সেটাকে বিএমএ বা সরকারী ডাক্তারদের দল নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখাবে, বলবে, হু হু দেখেছো, আমরা না থাকলে কি আর জেইল থেকে বেরুতে পারতে? জীবনের প্রথম পুলিশি ঝামেলায় পরে জেলে যাওয়া বেচারা বিহ্বল ডাক্তার সেটাকেই পরম সৌভাগ্য বলে গৃহপালিত ডাক্তার নেতার পায়ে কদমবুছি করতে থাকবেন। দুইদিকেই লাভ, যেতেও কাটবে আবার আসতেও কাটবে।
আমি এই বিপদ যে আসতে পারে, সেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে কথা বলছি। ডাক্তারদের ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বলেছি, কোথাও কোথাও জুনিয়র ডাক্তারদের গুণ্ডামীর বিরুদ্ধে বলেছি। আমি বলেছি এইসব ঘটনা চিকিৎসকদের জনগন থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করবে। বিনিময়ে পেয়েছি ডাক্তার সম্প্রদায় থেকে বিরামহীন গালি। উল্লেখ করা যেতে পারে সেখানে এই গালিবাজদের সিনিয়র কিছু ডাক্তার দুঃখজনকভাবে উৎসাহিত করেছেন।
মাথায় রাখবেন জনগন ছাড়া আপনার আর কোন প্রোটেক্টর নেই। জনতার মাঝেই আপনাকে আশ্রয় নিয়ে হবে, সেই হবে আপনার রক্ষক। আপনি যেই বিপদে সেই বিপদ থেকে আপনাদের রক্ষা করতে পারে একমাত্র জনগন, আর কেউ নয়, আর কোন শক্তি নয়।
প্লিজ এবার একটু নিজেদের দিকে নিজেদের পেশার দিকে নজর দিন, ত্রুটিগুলোকে চিহ্নিত করুন, প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নিন। আপনারা মানুন আর না মানুন, আপনাদের পেশার মধ্যে কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়েছে, তাদের চিহ্নিত করুন। জনগনের মন থেকে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ দূর করার চেষ্টা একদিনেই সফল হবেনা, কিন্তু এটা দূর করা সম্ভব, খুবই সম্ভব। সেইজন্য চিকিৎসকদেরকেই কিছু আন্তরিক পদেক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথম যেই পদক্ষেপ নিতে পারেন সেটা হচ্ছে, প্রত্যেক উপজেলায় স্থানীয় বি এম এ স্থানীয় সমাজ নেতাদের সাথে নিয়ে একটি করে “রোগী সহায়তা কেন্দ্র” খুলবেন, সেখানে রোগী হেনস্থার অভিযোগ গ্রহণ করা হবে, এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে সেগুলোর নিস্পত্তি করতে হবে। চিকিৎসকের ত্রুটি পাওয়া গেলে, তাকে রক্ষার চেষ্টা না করে তার অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, এমনকি তার রেজিস্ট্রেশন সাময়িক স্থগিত করা থেকে বাতিল করা পর্যন্ত শাস্তি দিতে হবে। এই শাস্তির সুপারিশ আসবে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে, তাঁরা সেই শাস্তি কার্যকর করবে।
উপজেলার রোগী সহায়তা কেন্দ্র হয়ে উঠবে সবার আশা ভরসার স্থল। তার রাগ তখন আর আপনার মাথায় ভাঙবে না, সে সেটা বলার একটা জায়গা পেয়েছে। এটা একটা মাত্র উদাহরণ। জনগনের সাথে দুরত্ব কমানোর জন্য এমন আরো অনেক কাজ আছে সেটা করতে হবে।
মিছিল মিটিং করে, ফেবুর পাতা গরম করে বা সরকারের কাছে ধর্ণা দিয়ে কোন লাভ নেই। প্রফেসর এবিএম আবদুল্লাহর মতো প্রভাবশালী, পলিটিক্যালি কানেক্টেড বরেণ্য চিকিৎসকও সুরক্ষিত নয়, তাহলে ভাবুন আপনি কীভাবে সুরক্ষিত হবেন?
তাই আসল কাজে মন দিন, উপকার হবে।
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন