সকলেই জানেন আমি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুসলিমদের নিপীড়িত বলে মনে করি। আমি দ্বিধাহীন ভাবে ধর্ম হিসেবে ইসলামের এবং ইসলামের নবীর প্রশংসা করি। নাস্তিকতার নামে নিউ এথিস্টদের ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কলম ধরি। মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে নিউ এথিস্টদের যে প্রতিক্রিয়াশীল ক্রোধ আছে, মাদ্রাসার ঐতিহাসিক ভুমিকাকে অস্বীকারের মাধ্যমে মাদ্রাসাকে জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা বলে নিউ এথিস্টরা নিজস্ব বয়ান তৈরি করছে, তখনই আমি রাজা রামমোহন রায়ের মাদ্রাসায় পড়ার ইতিহাস তুলে এনেছিলাম। সেই ঘটনা জেনে নিউ এথিস্টদের বিহ্বল ভাব এখনো কাটেনি। তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার সাথে এই ঘটনা মেলাতে পারেনা। ইসলাম প্রশ্নে আমার অবস্থানকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চায় এভাবে। ১/ আমি জানের ভয়ে ইসলাম সম্পর্কে এই অবস্থান নিয়েছি। ২/ কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন আমি ইসলামপন্থীদের কাছে নিয়মিত মাসোহারা পাই। ৩/ বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে এটা আমার অস্তিত্বের কৌশল। আমার অবস্থানকে কোনভাবেই তাঁরা একটি স্যেকুলার পজিশন বলে মানতে নারাজ। কারণ মানুষ হিসেবে তাঁরা অবিকশিত। তাঁদের চিন্তার প্রতিক্রিয়াশিলতা দিয়ে তাঁরা দুনিয়ার সবকিছুকে বিচার করে। এই প্রসঙ্গে এবার আসুন বাঙালি মনীষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখা দেখি ইসলাম এবং ইসলামের পয়গম্বরকে নিয়ে। ১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর মির্জা আলি আকবর খাঁর সভাপতিত্বে মুম্বাই-এ অনুষ্ঠিত হয় ‘পয়গম্বর দিবস’। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বানীটি পাঠান। বানীটি সেদিন পাঠ করে শোনান সরোজিনী নাইডু। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “জগতে যে সামান্য কয়েকটি মহান ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম তাদেরই অন্যতম। মহান এই ধর্মমতের অনুরাগীদের দায়িত্বও তাই বিশাল। ইসলামপন্থীদের মনে রাখা দরকার, ধর্ম বিশ্বাসের মহত্ত্ব আর গভীরতা যেন তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ওপরও ছাপ রেখে যায়। আসলে, এই দুর্ভাগা দেশের অধিবাসী দুটি সম্প্রদায়ের বোঝাপড়া শুধু তো জাতীয় স্বার্থের সপ্রতিভ উপলব্ধির উপর নির্ভর করে না, সাহিত্যদ্রষ্টাদের বানী নিঃসৃত শাশ্বত প্রেরণার ওপরও তার নির্ভরতা। সত্য ও শাশ্বতকে যারা জেনেছেন ও জানিয়েছেন, তাঁরা ঈশ্বরের ভালবাসার পাত্র, এবং মানুষকেও তাঁরা চিরকাল ভালবেসে এসেছেন।” হযরত মোহাম্মদের জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন স্যার আবদুল্লা সোহরাওয়ার্দিকে। ১৯৩৪ সালের ২৫ জুন বেতারে রবীন্দ্রনাথের এই বাণী প্রচারিত হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “ ইসলাম পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মের মধ্যে একটি। এই কারণে ইহার অনুবর্তীগণের দায়িত্ব অসীম, যেহেতু আপন জীবনে এই ধর্মের মহত্ত্ব সম্বন্ধে তাহাদিগকে সাক্ষ্য দিতে হইবে। ভারতে যে সকল বিভিন্ন ধর্মসমাজ আছে, তাদের পরস্পরের প্রতি সভ্য জাতিযোগ্য মনোভাব যদি উদ্ভাবিত করতে হয়, তবে কেবল মাত্র রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা তাহা সম্ভবপর হইবে না, আমাদের নির্ভর করিতে হইবে সেই অনুপ্রেরণার প্রতি, যাহা ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র ও মানবের বন্ধু সত্য দূতদিগের অমর জীবন হইতে চির উৎসারিত। অদ্যকার এই পুণ্য অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মুসলিম ভ্রাতৃদের সহিত এক যোগে ইসলামের মহাঋষীর উদ্দেশ্যে আমার ভক্তি-উপহার অর্পণ করিয়া উৎপীড়িত ভারতবর্ষের জন্য তাঁহার আশীর্বাদ ও সান্ত্বনা কামনা করি।” এ সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় বাণীটি প্রকাশিত হয় নয়াদিল্লীর জামা মসজিদ প্রকাশিত ‘দ্যা পেশওয়া’ পত্রিকার পয়গম্বর সংখ্যায়। ১৯৩৬-এর ২৭ ফেব্রুয়ারী শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছা বার্তাটি পাঠান। তৃতীয় বাণীতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “ যিনি বিশ্বের মহত্তমদের অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হজরত মহম্মদের উদ্দেশ্যে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন, সম্ভাবনাময় জীবনীশক্তির সঞ্চার করেছিলেন পয়গম্বর হজরত, এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচারণের আদর্শ। সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করি, পবিত্র পয়গম্বর প্রদর্শিত পথ যারা অনুসরণ করেছেন, আধুনিক ভারতবর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তাঁরা যেন এমনভাবে ইতিহাসকে গড়ে তোলেন যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও পারস্পরিক শুভেচ্ছা অটুট থেকে যায়।” একজন সত্যিকারের স্যেকুলার মানুষই পারেন এমন চিন্তা করতে। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় চাপাতির ভয়ে এই লেখা লেখেননি। অথবা এই লেখাগুলো তাঁর কোন কৌশলও নয়। ইসলাম বিরোধিতাই যাঁদের কাছে প্রগতিশীলতার নামান্তর তাঁরা অবশ্য এখন রবীন্দ্রনাথকেও জঙ্গি ঘোষণা করতে পারে। ফরহাদ মজহার ও এবাদতনামায় লিখেছিলেনঃ “আমাদের রবিবাবু মস্তোবড়ো কবি, সাহেবেরা নোবেল প্রাইজ দিয়ে হক্ তার সাহিত্য কীর্তির করেছে কদর। ইংরেজের ঘেঁটু হয়ে তার বাপ দাদা মালপানি কামিয়েছে। ব’নেছে স্বঘোষে জমিদার কিন্তু বংশের দোষে জল পড়া পাতা নড়া প্রভু কভু বন্ধ হয় নাই- সে হয়েছে বিশ্বের শায়ের। তাঁহারে সালাম করি তাঁহারে মারহাবা কহি প্রাণে পরওয়ারদিগার তবু দিল্ মোর বহুত নাখোশ তাঁর প্রতি। ছিল দোষ রবীন্দ্রের। তেনার কলমে বহু পয় পয়গম্বর সাধক ও মনীষীর নাম হয়েছে স্মরণ কিন্তু ঘূণাক্ষরে নবী মুহম্মদ আকারে ইঙ্গিতে ভাবে দিলে কিম্বা নিবের ডগায় একবারও আসে নাই, তাঁকে তাই মাফ করি নাই। ঠাকুরের বেটাটারে তুমি কিন্তু রহমান করে দিও মাফ।” বুঝতেই পারছেন তিনিও মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন। আরেকদিকে এক শ্রেণীর ইসলাম পন্থী রবীন্দ্রনাথ নামটিকে কলঙ্কিত করতে চায়। কল্পিত ঘটনা এবং কোন রেফারেন্স ছাড়াই রবীন্দ্রনাথকে মুসলিম বিদ্বেষী বলে প্রচার করতে চায়। সেই নির্বোধরা জানেওনা রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করতে গিয়ে আসলে তাঁরা কোন মহান মানুষকেই তাঁরা নিয়ত আঘাত করে চলেছে। এবং অর্থহীন মানসিক সংঘাতে লিপ্ত হয়ে নিজেদের হাস্যকর এবং বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে মধ্যবিত্ত বাঙালির মানস থেকে।
