কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, সর্বহারার শৃংখল ছাড়া হারাবার কিছু নেই। তখন সম্ভবত প্রাচ্যের সর্বহারাদের কথাটা ভাবেননি। প্রাচ্যের সর্বহারাদের শৃংখল ছাড়াও আরেকটা বিষয় আছে হারাবার, আর সেটাই তাকে বেচে থাকার স্বপ্ন আর শক্তি জোগায়, সেটা হচ্ছে, ধর্ম।
বাংলাদেশের স্যেকুলার চিন্তা ও মনোকাঠামো পশ্চিমের চিন্তা দিয়ে প্রভাবিত। পশ্চিমের চিন্তা মানেই খারাপ কিছু নয়, কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ পলিটিক্যাল প্রপঞ্চ যদি পশ্চিমা চিন্তা দিয়ে প্রভাবিত হয় তাহলে সেটার সামাজিক প্রভাব অনাবশ্যকভাবে নেতিবাচক, ভয়ানক ও বিপদজনক হতে পারে।
পশ্চিমে চার্চ এবং ধর্ম ক্ষমতার অংশ ছিলো। সে ছিলো সরাসরি শোষক। ধর্ম নিষ্পেষণ করেছে সাধারন মানুষকে। গির্জার অর্থনৈতিক শোষন আর রাজনৈতিক ক্ষমতার রিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হয়েছে ইউরোপের মানুষদের। তাই ধর্মের সাথে তাদের একটা ঐতিহাসিক বিরোধের শর্ত তৈরি হয়েছে।
আমাদের এখানে শাসকের সাথে ধর্মচিন্তা যখনই হাত মিলিয়েছে সাধারন মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে যেমন সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত দীন ই ইলাহী।
আমাদের ভুখণ্ডে ধর্ম সবসময়েই নিপীড়িতের পক্ষে থেকেছে, নিপীড়িতের লড়াইয়ের সাথী হয়েছে। আমাদের কৃষক বিদ্রোহগুলো, শ্রী চৈতন্যের জাতপাত বিরোধী লড়াই, সিপাহী বিদ্রোহ, দেওবন্দের লড়াই, এমনকি বাংলায় জংগল কেটে বসতি স্থাপনের লড়াইও ধর্মের হাত ধরেই হয়েছে। ধর্মের সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক সেকারণেই পশ্চিমের মতো নয়।
এখনো আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে যেই সামাজিক শ্রেনী ধর্ম পালন ও ধর্মীয় শিক্ষা নেয় তারা মুলত দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ধর্ম তার আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর জীবনের হাজারো সমস্যাকে সহ্য করার শক্তি আর প্রেরণা।
এই দেশে তাহলে পশ্চিমের ইতিহাস আর চিন্তা দিয়ে প্রভাবিত স্যেকুলার চর্চা, স্যেকুলার বিশ্বাস, স্যেকুলার লক্ষ্য অর্জন করাটা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নিতে হবে?
আমি চাই আমাদের সমাজে ও রাজনীতিতে ধর্মকে আমাদের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার করা হোক। পশ্চিমের স্যেকুলারিজমের ধারণা ও চর্চাকে আনকৃটিক্যালি গ্রহন না করা হোক।
গত পাচ বছর ধরে আমি নানাভাবে এই কথাগুলোই বলে আসছি। আমার লেখা যারা পড়েন তারা আমার এই কথাগুলোকেই বারেবারে দেখেছেন। এই স্পস্ট কথাগুলো কোন অজানা কারণে বাংলাদেশের স্যেকুলারেরা বুঝতে চায়না। সেটা তাদের চিন্তার অক্ষমতা কিনা জানিনা।
তাদের কাছে ধর্মের ইতিবাচক বিষয় নিয়ে কথা বলাটাই প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী, জংগীবাদি, ফ্যানাটিক, পরিত্যাজ্য।
বাংলাদশের রাজনীতিতে এই অদ্ভুত স্যেকুলার মনোকাঠামো এক ভয়ানক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এই তথাকথিত স্যেকুলারদের কথা শুনেই পশ্চিমের মানুষেরা বাংলাদেশ নিয়ে তাদের সব ধারণা তৈরি করে। তারা ভাবে এই দেশটা একেবারে গোল্লায় যাচ্ছে।
আমি পশ্চিমকেও বলতে চাই। আপনারা শুধু ওদের নয় আমাদের কথাও শুনে দেখুন। আমরাও বাংলাদেশের লিবারেল ভয়েস, আমাদেরকে তথাকথিত স্যেকুলারেরা আপনাদের কাছে যেভাবে উপস্থাপিত করে, আমরা সেটা নই। কিন্তু আমাদের কথা আপনাদের কাছে কোনভাবেই পৌছুচ্ছেনা, এটা হতাশাজনক।