ডা সানী আমার উদ্দেশ্যে সরাসরি কিছু প্রশ্ন রেখেছেন ফেইসবুকে লিঙ্ক। প্রশ্নগুলো পয়েন্ট আকারে দেয়ার অনুরোধ করায় পয়েন্ট আকারেও দিয়েছেন তিনি। প্রশ্নগুলো হচ্ছে।
“এতো গালিগালাজ খেয়ে কেন তিনি সমানে ফেসবুকিং করে যাচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে যে রিউমারের পাহাড় জমছে, সেগুলো সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য কি? ফরহাদ মাজহার সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন আর তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা প্রকাশ করে তিনি আসলে কি বোঝাতে চাইছেন। হেফাজত, জামায়াত এবং অপরাপর রাজনৈতিক দল সম্পর্কে তাঁর ভাবনা কি, তা নিয়েও রয়েছে বেশ কিছু কনফিউশান। প্রশ্ন আরও ছিল। আর সেটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে। রিউমার গুলো হচ্ছে, আমি হেফাজতের সমর্থক, আমি মাদ্রাসা শিক্ষার সমর্থক। আর র’এর এজেন্ট, কিংবা ক্ষমতাশীল দলের ইচ্ছায় ই আপনি এসব লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। “
প্রথমেই সানীকে ধন্যবাদ; প্রশ্নগুলো করার জন্য। যদিও আমি নানা সময় এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিয়েছি। কিন্তু এটাও সত্য ফেইসবুকে আমার পাঠক বেড়েছে, সেই সাথে শত্রুও বেড়েছে, বেড়েছে আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা। আমার নতুন পাঠকেরা হয়তো পুরোনো লেখা পড়েননি। তাই এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর আবার গুছিয়ে দেয়াতে অসুবিধা নাই।
প্রশ্ন ১ঃ এতো গালিগালাজ খেয়ে কেন তিনি সমানে ফেসবুকিং করে যাচ্ছেন?
উত্তরঃ
চমস্কি এবং এডয়ার্ড হারমান আমেরিক্যান মিডিয়ার একটা প্রোপ্যাগান্ডা মডেল প্রোপৌজ করেছিলেন। কীভাবে একটা সংবাদ থেকে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে যায় এমন খবর কে ফিল্টার করতে করতে শেষ পর্যন্ত খবরটাকে ই নাই করে দেয়া হয়। অথবা কীভাবে মিডিয়া দিয়ে রাষ্ট্রের কাজে সামাজিক কনসেন্ট আদায় করা হয়। উনারা বলেছিলেন পাঁচটা স্তরের ফিল্টার আছে। এর মধ্যে আছে মালিকানা, বিজ্ঞাপন, সৌর্স অব ইনফৌ, কমিউনিজম ভীতি (যা বর্তমানে ইসলাম ফোবিয়া) আর ফ্ল্যাক (FLAK)। ফ্ল্যাক শব্দটার অনেক অর্থ আছে। একটা অর্থ হচ্ছে নিন্দাবাদ বা গালাগালি করে কাউকে নিরস্ত করার চেষ্টা। সৌশাল মিডিয়া একটা অতি শক্তিশালী মাধ্যম। এখানেও নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করা হবে। নিশ্চয় হবে। এই পাঁচটা ফিল্টারের মধ্যে কোনটা কি সৌশ্যাল মিডিয়াতে কার্যকর হবে? না হবেনা। শুধু ফ্ল্যাক এবং ভীতি উৎপাদন ছাড়া কোনটাই হবেনা। এখানে মালিকানা নেই, বিনিয়োগ নেই, বিজ্ঞাপন নেই, লেখার জন্য কারো কাছে হাত পাততে হয়না। সেকারণেই সৌশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন নিন্দাবাদি বা গালিবাজ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে সিপি গ্যাং এর উদাহরণ নিতে পারেন, এবং তাদের পিছনে অনুদানের নামে সরকারী অর্থায়নের খবর সংবাদপত্রে এসেছিল। এইসব গালিবাজ গ্রুপ যারা তৈরি করেছে তাঁরা বুদ্ধিমান, লেখাপড়া জানা কামেল মানুষ। আমাদের সমাজে মিডিল ক্লাস ভ্যালুজে “ফ্ল্যাক” একটি অতি কার্যকর পদ্ধতি। ইজ্জত হারানোর ভয় তাদের সবচেয়ে বেশী। গালি খেয়ে এই মধ্যবিত্ত ইজ্জত হারাতে চায়না।
ভবিষ্যতে এই অনলাইনে যারা লেখালেখি করবেন, পরিচিতি পাবেন তাঁদের গণ্ডারের মতো চামড়া থাকতে হবে। এখানে আইডিয়া যত সহজে ছড়িয়ে দিতে পারেন, পাঠককে প্রভাবিত করতে পারেন জনমানসকে আপনার চিন্তায় ঋদ্ধ করতে পারেন সেটা আর কিছুতে সম্ভব নয়। এবং সেই বিপুল শক্তি যদি আপনি চান তবে এই গালাগালির যন্ত্রনা সহ্য করতেই হবে। এই ফেইসবুকই আমাকে লেখক হিসেবে পরিচিত করেছে। কারো হাতেপায়ে ধরতে হয়নি লেখা প্রকাশের জন্য, কাউকে ডেকে ডেকে আমার লেখা পড়াতে হয়নি।
লেখক চায় তার লেখা পাঠক পড়ুক। আমি সেই পাঠক পেয়েছি এখানেই, আমার দায়বদ্ধতা তো তাদের কাছেই। আমি লেখা ছেড়ে দিলে আমার শত্রুদের লাভ। আমার শত্রুরা সেটাই চায়। সেই লাভ আমি কোনদিন হতে দেব? মোটেই না। গালি দিয়ে ওরা গলা দিয়ে রক্ত বের করে ফেললেও না। আমার সো কল্ড মিডল ক্লাসের ইজ্জত যাওয়ার ভয় নাই। এই গালিবাজেরা কাপুরুষ। এদের সাহস থাকলে সামনে আসতো। আর সামনে আসলে এদের নাকমুখ ধসিয়ে দেয়ার শক্তি আমার আছে।
প্রশ্ন ২ঃ তাঁকে ঘিরে যে রিউমারের পাহাড় জমছে, সেগুলো সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য কি?
উত্তরঃ
উত্তর, প্রশ্নেই আছে এগুলো রিউমার। রিউমার হয় কাদের নামে? যাদের সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ আছে। আমার সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ছে মানুষের এটা আনন্দের বিষয়। আমি যেহেতু সরকার বিরোধী মানুষ। এইসব রিউমারের ভগ্নাংশও যদি সত্য হত তাহলে সরকার আমাকে ছেড়ে দিত?
প্রশ্ন ৩ঃ ফরহাদ মজহার সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন আর তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা প্রকাশ করে তিনি আসলে কি বোঝাতে চাইছেন?
উত্তরঃ
আমি ফরহাদ ভাইকে এই সময়ের বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ মনীষা বলি। সেটা আমি আগেও বলেছি। এটা আমার একান্ত নিজের মূল্যায়ন। এর সাথে অন্যদের একমত হতে হবে এমন কোন কথা নেই। ফরহাদ ভাইয়ের “ভাবান্দোলন” আমার চিন্তাকে আমুল নাড়া দিয়েছে। বাঙলার মাটির চিন্তাকে ফরহাদ ভাই ধরতে পেরেছেন। তিনিই আমাকে বুঝতে শিখিয়েছেন ইউরোপের আধুনিকতার ইতিহাস আমার নিজের ইতিহাস নয়। আজকের ইউরোপ যে পর্যায়গুলো অতিক্রম করে ইউরোপ হয়েছে সেই ইতিহাসের কণ্টকময় দীর্ঘ পথে সে যাত্রা না করেই আমরা তার সব ফল উপভোগ করতে পারবো না। কারণ, একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের অভিজ্ঞতা আরেক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস নির্মাণে প্রাসঙ্গিক নাও হতে পারে। ইউরোপের পোশাকটা ধার করলেই চলবে না বরং বিপ্লবটাকে আত্মস্থ করতে হবে।বাংলার জমিতে দাড়িয়ে বাংলার ইতিহাস নির্মাণের পথ খুজে নিতে শিখিয়েছেন ফরহাদ ভাই। শুধু আমাকে নয় একটা বিশাল প্রজন্মকে তিনি চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। এই প্রজন্মই বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ভবিষ্যৎ।
ফরহাদ ভাইকে নিয়ে অনেক ভুল বুঝা আছে। একটা কারণ ফরহাদ ভাইয়ের লেখা না পড়া। আরেকটা কারণ তার কাছে আমরা যেই প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই সেগুলো সব সময় লিখিত ভাবে না থাকা। ফরহাদ ভাইয়ের সাথে আমি মাঝে মাঝেই সময় কাটাই। উনার সাথে আলোচনাগুলো কখনো কখনো রেকর্ড রাখি। এই অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আরেক অন্য ফরহাদ মজহার ধরা পড়েন যাকে আমরা হয়তো উনার লেখায় পুরোটা ধরতে পারিনা। ফরহাদ ভাই যদি অনুমতি দেন তাহলে সেই বিশাল আলাপের অনেকটাই বই আকারে প্রকাশ করবার ইচ্ছা আছে। উনার মতো চিন্তকের নানা আলাপের এমনকি এসব ঘরোয়া আলাপেরও অসামান্য মুল্য আছে।
প্রশ্ন ৪ঃ হেফাজত, জামায়াত এবং অপরাপর রাজনৈতিক দল সম্পর্কে তাঁর ভাবনা কি?
উত্তরঃ
আমার মনে হয় প্রশ্নটা হবে ধর্মবাদী দলগুলো সম্পর্কে। যাই হোক জামাত সম্পর্কে আমার লিখিত মুল্যায়ন আছে এই লিঙ্কে। জামাত সম্পর্কে আমার মূল্যায়নটা দুই স্তরের; প্রথমটা ফিলসফিক্যাল যা পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আর একটা যুদ্ধাপরাধের দায় সংক্রান্ত। আমার গত একুশের বইমেলায় প্রকাশিত বই ধর্ম ও নাস্তিকতার প্রথম চ্যাপ্টারে আমি জামাত প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলাপও করেছি। এই সবগুলোই প্রকাশ্য ডকুমেন্ট তারপরেও কারো কোন কনফিউশন থাকা মানে হয় সে আমার লেখা পড়েনি বা পড়েও বুঝতে পারেনি। আমার সরল বাঙলায় লেখা পড়ে যদি কেউ বুঝতে না পারে তবে তাঁকে বুঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার নাই।
হেফাজত একটা ফ্রন্ট, তাঁরা কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তাঁদের (হেফাজতের) মনে সন্দেহ জেগেছে যেই কারণেই হোক বাংলাদেশে মুসলমানদের ঈমান ও আকিদার উপর আক্রমণ আসছে। সেটার মোকাবেলা করতে হবে। এসব কিছুই তাঁদের ঘোষিত কথা, সবাই জানে। এখন লক্ষ্য করে দেখুন, হেফাজতের মুসলমানদের ঈমান ও আকিদা রক্ষার এবং ধর্ম চর্চার অধিকারের দাবী কি কোন ধর্মবাদী দাবী? না এটা ধর্মবাদী দাবী নয়, বরং মর্মের দিক থেকে এটা একটা স্যেকুলার দাবী। যেই স্যেকুলারিজম মানে ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা। স্যেকুলারেরা তাহলে কোন বিবেচনায় হেফাজতের সমালোচনা করে?
প্রশ্ন ৫ঃ আমি মাদ্রাসা শিক্ষার সমর্থক??!!
উত্তরঃ
এই প্রশ্নটা একটা ডিজঅনেস্ট প্রশ্ন। কারণ আমি নিজে কি কোনদিন বলেছি যে আমি মাদ্রাসা শিক্ষার সমর্থক? বা আমি কি বলেছি যে বাংলাদেশে শুধু মাদ্রাসা শিক্ষাই থাকবে? যদি না বলে থাকি তবে এই প্রশ্ন কেন? স্যেকুলারদের মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে চুলকায় কেন? এটা বরং আমার প্রশ্ন। যেই শিক্ষা ব্যবস্থাটা একটা এন্টি কলোনিয়াল স্ট্রাগলের মধ্যে দিয়ে ডেভেলপ করেছে এবং যেই শিক্ষা ব্যবস্থা কমিউনিটি ফান্ডিং এ চলে, পৃথিবীর সব দেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে সেখানে বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে স্যেকুলারদের তীব্র ঘৃণা সত্যিই বিস্ময়কর। মাদ্রাসা নিয়ে আমার পজিশন স্যেকুলারদের বিপরীত। স্যেকুলারেরা মনে করে মাদ্রাসায় জঙ্গি উৎপাদন হয়, আমি মনে করিনা, আমি সেটা প্রমাণ করেও দিয়েছি যে এই প্রচার সত্য নয়। স্যেকুলারারা চায় মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ হোক, আমি চাইনা। স্যেকুলারেরা নিজেরা মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের নামে বারোটা বাজাতে চায়। আমি বলি, তুমি কে হে আধুনিকায়ন করার। ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই।
প্রশ্ন ৬ঃ আমার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে কী?
উত্তরঃ
আমি আগেও অনেকবার বলেছি, আমি পুঁজিবাদের সময়টাকে অতিক্রম করে যেতে চাই। আমি বাংলাদেশের বর্তমান বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সাম্য, মানবসত্তার মর্যাদা আর ইনসাফের ভিত্তিতে একটা ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র চাই। সেটাই আমার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এই রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পোষণ করার জন্য কোন রাজনৈতিক দল করা জরুরী নয়। এবং আমার রাজনৈতিক আকাঙ্খাকে এই মুহুর্তে কোন রাজনৈতিক দল ধারণ ও করেনা।
পরিশেষে; আমার পাঠক ও হেইটার সবার উদ্দেশ্যেই বলি; আমার সাথে সহমত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভিন্নমতটি বরং বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বার্নার্ড উইলিয়ামস তাঁর এথিক্স অ্যান্ড লিমিটস অব ফিলসফিতে লিখেছেনঃ
‘Disagreement does not necessarily have to be overcome.’ Indeed, it ‘may remain an important and constitutive feature of our relations to others, and also be seen as something that is merely to be expected in the light of the best explanations we have of how such disagreement arises’
“মতানৈক্যকে দূর করতে হবে, এমন কোন কথা নেই।’ বস্তুত, মতানৈক্য আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হতে পারে, সেই সম্পর্কের একটা উপকরণ হয়ে উঠতে পারে, এবং কীভাবে মতানৈক্যর সৃষ্টি হচ্ছে, তার শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাগুলির আলোয় দেখলে মনে হতে পারে যে মতানৈক্যই প্রত্যাশিত।”
আসলে আমাদের সমস্ত দাবী ভিন্ন ভিন্ন যুক্তির উপরে দাঁড়িয়ে থাকে, যুক্তিগুলো যদি বায়াসড না হয় তাহলে পরস্পর বিরোধী হলেও কোনটাকেই যথেচ্ছ বলে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়, কোনটাকেই ভিত্তিহীন বলে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়।
পৃথিবীতে “সর্বশ্রেষ্ঠ” বলে কিছু নেই; আছে “অধিকতর ন্যায্য” বলে একটা অবস্থান। আমরা যদি সমাজ এবং রাষ্ট্রকে অধিকতর ন্যায্যতার দিকে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে সবার কথাই শুনতে হবে, শুধু নিজের কথা শুনিয়ে গেলে চলবে না।আমি অন্যের কথা শুনি এবং অধিকতর নায্য অবস্থানের দিকে আমার চিন্তাকে এবং তার সাথে আমার অবস্থানকে ধাবিত করি। আমি পাথরের মত স্থির নই, আমি ঝর্ণার মত চঞ্চল।