আমার কাছে সব সময়ই এটা একটা ধাঁধা ছিল কেন বাংলাদেশের রোগীরা ভারতে চিকিৎসা করাতে যায়? কেন বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নামে এত অভিযোগ? কেনই-বা চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীদের বিদেশগামী মিছিল ক্রমবর্ধমান?
এই বিষয়ে একটা ইন্টারেস্টিং আলাপ করার সুযোগ হলো আমার দুই সহপাঠীর সঙ্গে। যারা বাংলাদেশে চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষিত, বাংলাদেশেও ডাক্তারি করেছে এবং এখন ভারতে ডাক্তারি করেন। এই দারুণ অভিজ্ঞতা পরিস্থিতি মূল্যায়নে কাজে লাগতে পারে; তাই ওদের একই প্রশ্ন করলাম। দু’জনই দু’দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার মান নিয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। আমি দু’জনের নাম উল্লেখ করছি না, দু’জনই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। একজন ভারতের একটি নামকরা ক্যান্সার হাসপাতালের বোন-ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিটের প্রধান এবং আরেকজন হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ।
প্রথমেই দু’জন বলে নিলেন যে, সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি চিকিৎসকদের মান সর্বভারতীয় মান থেকে অনেক পিছিয়ে। তারপরও সেটা বাংলাদেশের সার্বিক মান থেকে ভালো। আমি জানতে চাইলাম, ঠিক কোথায় কোথায় ভালো? কেন ভালো?
আমার হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বন্ধু বলতে শুরু করলেন~
১। আমরা এখানে এককভাবে কোনো চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেই না। হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারে সেটা নেয়ার সুযোগ নেই। আমরা একসাথে রেডিয়েশন অনকোলজি, মেডিক্যাল অনকোলজি এবং সার্জিক্যাল অনকোলজি বিশেষজ্ঞ একসাথে রোগী দেখি, প্ল্যান অব ট্রিটমেন্ট একসাথে করি আর রোগী এবং রোগীর সাথের মানুষকে নিয়ে কাউন্সিল করি। আমরা ব্যাড নিউজ চেপে রাখি না। যেই রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁর চিকিৎসা শুরু করার জন্য উৎসাহিত করি আর যেই রোগী ভালো হবে না তাঁর শুধু ব্যথা-বেদনা উপশমের চিকিৎসা করার উপদেশ দেই। সে কারণেই রোগী একেক জনের কাছ থেকে একেক রকম সাজেশন পায় না। ফলে রোগী বা রোগীর মানুষ বিভ্রান্ত হয় না।
২। রোগীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় কত টাকা খরচ হবে সেটার ধারণা দেই। রোগীর যদি সেই আর্থিক সামর্থ্য না থাকে তবে আমরা সেই রোগীর চিকিৎসা শুরু করি না। কারণ, চিকিৎসা শুরু করে মাঝপথে থেমে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না।
এবার দু’জনই বলতে শুরু করলেন, আরো কিছু বিষয় আছে যেগুলো ভারতীয় চিকিৎসকদের আলাদা দক্ষতা তৈরি করেছে। যেমন: সুপার স্পেসালাইজেশন। ধরা যাক, একজন ক্যান্সার সার্জন বা অনকোলজি সার্জন হতে চান। তাঁকে আগে জেনারেল সার্জারিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে তারপর ক্যান্সার সার্জারিতে সুপার স্পেসালাইজেশন করতে হবে। এমবিবিএসের পর মোট সময় লাগবে কমপক্ষে ছয় বছর। বাংলাদেশে সুপার স্পেসালাইজেশনের এই ব্যবস্থা নেই। কেউ কেউ ব্যাক্তিগতভাবে এভাবেই সুপার স্পেসালাইজেশন করে থাকেলও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জেনারেল সার্জারি না করেও কেউ কেউ ইউরোলজি সার্জন হয়ে যেতে পারেন এবং সেটাই হচ্ছে। যেমন: বাংলাদেশে মেডিসিনে স্পেসালাইজেশন না করেও যে কেউ বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ হয়ে যেতে পারেন। এর ফলে যেটা হয়, সেটা হচ্ছেÑ সুপার স্পেসালাইজেশনের সুফল বাংলাদেশের রোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পায় না। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে কেউ সুপার স্পেসালাইজেশন ডিগ্রি নিতে পারে না, বাংলাদেশ ছাড়া। আগে মেডিসিন স্পেশালিস্ট না হয়ে কার্ডিওলজিতে ডিগ্রি নেয়া পৃথিবীর যে কোনো দেশে এখন অসম্ভব।
বাংলাদেশে এমবিবিএসের পর ডাক্তারদের লেখাপড়ার কোনো দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র। যারা সরকারি চাকরিতে ঢুকলো তারা বাধ্যতামূলক দুই বছর গ্রামে কাটানোর পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ঢোকার সুযোগ পায়। আর ভারতে যারা নিজস্ব মেধায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তির সুযোগ পায় তাঁরা মাসে ভারতীয় টাকায় ৫০ হাজার রুপি ভাতা পায়। তাই লেখাপড়া ছাড়া আর কোনো কিছুর চিন্তা করতে হয় না তাঁদের। আর বাংলাদেশে বেসরকারি ডাক্তাররা ‘নাইট ডিউটি’ করে সকালে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের ক্লাস করতে যান। দু’জনের আউটকাম তো একরকম হবে না।
ভারতে সদ্য পাস করা ডাক্তার যদি একটা ক্লিনিকেও কাজ করেন তবে তাঁর বেতন হয় মাসে ৪০ হাজার রুপি। বাংলাদেশে কোথাও সদ্য পাস করা ডাক্তার এই বেতন পান না। আমার পাওয়া তথ্য যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে বাংলাদেশি মুদ্রামানে ভারতীয় চিকিৎসকদের এক-তৃতীয়াংশ টাকা বেতন পায় বাংলাদেশের সদ্য পাস করা মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েটরা।
ভারতে মেডিক্যাল এডুকেশনের কোয়ালিটি কন্ট্রোল আরেকটা বিষয়। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোকেও মাত্র দু’বছরের জন্য ছাত্র ভর্তির অনুমতি দেয়া হয়। দু’বছর পরে আবার ইন্সপেকশন হবে, সেই ইন্সপেকশনে কোয়ালিফাই করলে আবার পরবর্তী দু’বছরের জন্য ছাত্র ভর্তির অনুমতি দেয়া হবে। ভারতে অনেক নামকরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ভর্তির অনুমতি মাঝে মাঝেই বাতিল হয়ে যায়।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ভারতের ডাক্তারদের অ্যাকাউন্টেবিলিটি। ভোক্তা অধিকার সেখানে রাষ্ট্র দারুণভাবে সংরক্ষণ করে। চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগে রাষ্ট্র রোগীবান্ধব অবস্থান নেয়। ফলে চিকিৎসকরা প্রতিনিয়ত একটা চাপের মধ্যে থাকে এবং ‘নলেজ আপ ডেট’ থেকে শুরু করে অতি সতর্কতার সঙ্গে রোগীর চিকিৎসা চালায়। আমার সেই বন্ধুদের হাসপাতালে সেই সময়ে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা ছিল ১১টি। একটি হাসপাতালেই এই সংখ্যা। সারা ভারতে তাহলে কতগুলো? বাংলাদেশে চিকিৎসা অবহেলায় স্বাধীনতার পর মাত্র একজন চিকিৎসক শাস্তি পেয়েছেন, তাও একজন চাকমা চিকিৎসক। সবচেয়ে ক্ষমতাহীন সম্প্রদায়ের মানুষ, তাই শাস্তি দেয়া সহজ হয়েছে। ভারতে প্রত্যেক বছর অসংখ্য চিকিৎসক শাস্তি পান।
শেষে আমার বন্ধুটি কয়েকদিন আগেই পাওয়া রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের একজন প্যাথলজির অধ্যাপকের দেয়া লিম্ফোমার রিপোর্টের কথা জানালেন। তিনি আমাদের দু’জনই শিক্ষক ছিলেন। তিনি এফএনএসি করে লিম্ফোমা বলে রায় দিয়েছেন। আমার বন্ধুটি বললেন, ‘স্যার এটা জানেন না যে, এফএনএসি করে লিম্ফোমা ডায়াগনোসিস করা যায় না, ইম্মিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি করতে হয়, এটা আমি মানতে পারি না। স্যারকে এই কথা কে বোঝাবে?’
আজকের দিনে কোনো মানুষ বদ্ধ দুনিয়ায় বাস করে না। সারা পৃথিবী তার জন্য খোলা। ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দিয়েছে তার সামনে পুরো পৃথিবী। সে নিজেই বিচার করে নিতে পারবে সেরা চিকিৎসাটি সে পাচ্ছে কি-না? বিন্দুমাত্র সন্দেহ দেখা দিলে সে আর সেই চিকিৎসকের কাছে ফিরে আসবে না। এই হতাশাজনক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে জরুরিভিত্তিতে বাংলাদেশে চিকিৎসা বিদ্যার এবং সাথে সাথে চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে হবে। আর সেটা না পারলে রোগীর বিদেশমুখী মিছিল ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।