আমারে নিয়া চেতনাবাজদের অপপ্রচারের সীমা নাই। কাল একজন আমারে ইনবক্সে লিংক পাঠাইলো, দশ বছর আগের আমি যখন পপুলার ফার্মার সিওও ছিলাম; সেই সময়ের একটা ঘটনা নিয়া এক চটিমার্কা ওয়েব পোর্টালের খবর।
ঘটনা অর্ধ সত্য, যা মিথ্যার চাইতে জঘন্য! এতে আমার প্রতিপক্ষের দেউলিয়াত্বই প্রাকাশিত হইছে। আফসোস, যে, গালগল্প করার মতো একটা বিষয় খুঁজে পেতে তাদের প্রায় এক যুগ সময় লেগেছে!
তখন দেশ চালাচ্ছিল, ওয়ান ইলেভেনের সরকার। ২০০৭ সালের শেষের দিকে বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় তারা কালা জ্বরের একটা ওষুধ কেনে দুই দফায়। প্রথম দফায় অল্প পরিমানে নেয়া হয় এবং দ্বিতীয় দফায় প্রায় পাচ কোটি টাকার একটি কার্যাদেশ পায় পপুলার ফার্মা। কার্যাদেশ পেয়ে প্রথম অর্ডারের পুরোটা করে। পরবর্তী অর্ডারের আংশিক ওষুধ সরবরাহ যখন সম্পন্ন হয়েছে; তখন ওষুধ ব্যবহারীদের কাছ থেকে জানা যায় এই ওষুধে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছেনা। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে দেয়, অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য তারা মাঠে যায়। সেই কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আমিও তাদের সাথে মাঠে যাই। সেখানে দেখা যায় অভিযোগের সত্যতা আছে। ওষুধ খেয়ে যেখানে প্রায় ১০০% রোগীর ভালো হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে ভালো হচ্ছে ৬০-৭০% রোগী। এটা সরকারী হিসাব, দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির অনুসন্ধানেও তা পাওয়া যায়।
মাঠ পর্যবেক্ষণ শেষে ফিরে এসে আমি আমার তৎকালীন কোম্পানিকে জানাই, যেহেতু একটা কোয়ালিটি ফেইলিওরের ইস্যু দেখা দিয়েছে তাই আমাদের উচিৎ সরবরাহকৃত প্রডাক্ট রিকল করে তা ফ্রেস প্রোডাক্ট দিয়ে রিপ্লেস করা। উল্লেখ্য ওষুধ শিল্পে রিকল ও রিপ্লেস করা কোন নতুন বিষয় নয়; এটা রেগুলার প্র্যাকটিস। পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত কোম্পানি কোয়ালিটি ফেইলরের জন্য রিকল এবং রিপ্লেস করে। গুগুলে DRUG RECALL লিখে সার্চ দিলেই এটা দেখতে পারবেন। পপুলার ফার্মা তখনই এই ওষুধগুলো রিকল ও রিপ্লেস করার জন্য চিঠি দেয় সরকারকে।
যেহেতু এই ওষুধ কেনার টাকাটা বিশ্ব ব্যাংক দিচ্ছিল, তাই সরকার তাদের অনুমোদান বা কনকারেন্সের জন্য চিঠিটা তাদের কাছে পাঠায়। পাঠানোর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় বেশ কয়েকদিন সময় লাগিয়ে ফেলে। এরই মাঝে একটা বেনামী চিঠি নানা জায়গায় ছড়িয়ে দিয়ে তাতে দাবী করা হয়, এই ওষুধে ভেজাল আছে; আর তা পরীক্ষা করা দেখা হয়েছে জার্মানির একটা ল্যাবে।
এই খবরটা তখন প্রথম আলো সহ সকল জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে প্রচার হয়; ফলে কিছুদিনের জন্য রিকল এবং রিপ্লেসের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। সরকার আরো একটা তদন্ত কমিটি করে, আলাদা ভাবে বিশ্ব ব্যাংকও একটা তদন্ত কমিটি করে। সরকারী তদন্তে কোয়ালিটি ফেইলিওরের জন্য সুনির্দিস্ট করে ওষুধ সরবরাহকারী কোম্পানিকে অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়না। পরবর্তীতে ডিজি হেলথের তরফ থেকে পেলাডিন নামে আরেকটি ডাচ ল্যাবরেটরি থেকে ওষুধটি পরীক্ষা করেও জার্মানির ল্যাবের মতো ফলাফল পাওয়া যায়।।
পপুলার ফার্মা নিজেও একটা তদন্ত কমিটি করে। আমি যেহেতু উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলাম না, সেহেতু সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সেই তদন্তের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার উপর।
এরপরে অ্যামেরিকা থেকে আসে বিশ্ব ব্যাংকের ইন্ট্রিগ্রিটি ডিপার্টমেন্ট। তারা শুনানি করে তিনদিন। শুনানিতে অংশ নেয়ার জন্য কোম্পানি আমাকেই মনোনীত করে। আমি লুকাছাপা না করে আমার পাওয়া তদন্তের সকল তথ্য তদের সামনে তুলে ধরি। এটা ছিল একটা কোয়ালিটি ফেইলিওরের ঘটনা। সংশ্লিষ্ট কোম্পানি নিজেরা যে সময় সমস্যাটি জানাতে পারে, ততক্ষণে এই টেকনিক্যাল ফেইলিওর কারো ইচ্ছা নিরপেক্ষ ভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। আমার তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য ও ব্যাখ্যা বিশ্ব ব্যাংকের ইন্ট্রিগ্রিটি ডিপার্টমেন্ট মেনে নেয় যে এই ফেইলিওরের পিছনে কোন ক্রিমিন্যাল ইনটেনশন নেই। তারা সরকারের কাছে শুরুতে আমাদের করা রিকল ও রিপ্লেসের চিঠিতে অনুমোদন দেয়।
পপুলার ফার্মা তারপরে যথারীতি আগের দেয়া ওষুধ যথানিয়মে ফিরিয়ে এনে, সেটা সহ বাকি ওষুধের সাপ্লাই সম্পন্ন করে। সেই ওষুধ সবগুলো সরকারী কর্মসুচীতে সাফল্যের সাথে ব্যবহারও হয়। তবে বলাই বাহুল্য পরবর্তি সাপ্লাইয়ের প্রত্যেক ব্যাচের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-র অনুমোদিত ল্যাবে ক্রস চেক করে সরকার সাপ্লাই নেয়। সাপ্লাই শেষ হবার পর যথানিয়মে পপুলার ফার্মা তাদের পেমেন্টও পায়।
ওয়ান ইলেভেনের সরকার ও বিশ্ব ব্যাংক (যারা পদ্মা সেতুর বিষয়ে দুর্নীতির আলাপ হইছিল সেই বাতাসেই অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়) এই দুই পক্ষের হাতে নিস্পত্তি হওয়া একটা ঘটনা নিয়ে আমাকে অন্যায় ভাবে কলংকিত করার লক্ষ্যে অপপ্রচার ও অপচেষ্টায় নেমেছে বাকশলিরা।
নাম না জানা ওয়েব পোর্টালে জাহিদুর রহমানের নামে ছাপা রিপোর্ট টা অর্ধসত্য। কারণ নেদারল্যান্ডের ল্যাব রিপোর্ট এর ভিতর দিয়ে ঘটনাটা শেষ হয় নাই। ঘটনাটা সাপ্লায়ার কোম্পানীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়ে নিষ্পত্তি হয় নাই বরং ওষুধ বদলে দিয়ে সেই ওষুধ ব্যবহার করে, কোম্পানীকে পেমেন্ট দিয়ে বিষয়টা সমাধা করা হয়েছিল।
আমি পপুলারে একজন বেতনভুক কর্মচারী ছিলাম, আমি পপুলারের মালিক নই। এমনকি আমি সেইসময়ে পপুলারের ওষুধ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রনের দায়িত্বেও ছিলাম না। কিন্তু এমনভাবে প্রচারণা চালানো হয়েছে যেন পপুলারের মালিক আমি আর আমি নিজ হাতে সেই ওষুধ উৎপাদন করেছিলাম। পপুলার ফার্মার কোয়ালিটি ফেইলিউরের জন্য যদি কোন সমালোচনা হয় তাহলে সেটা হবে কোম্পানীর নামে সেই কোম্পানিতে কর্মরত ওষুধ উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কোন ব্যক্তির নামে নয়।
যেহেতু আমি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনের সমালোচনা করি তাই আওয়ামী পন্থী চিকিৎসক আর কোনকিছু খুজে না পেয়ে আমার সাবেক কোম্পানী যা আমি ২০১০ সালেই ত্যাগ করেছি সেই কোম্পানীর কোয়ালিটি ফেইলিউরের দায় আমার উপরে চাপিয়ে আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করার অপকৌশল নিয়েছে।
এদের বুদ্ধির বহর দেখে আমি বিদ্রুপের হাসি হাসতেছি। সৌভাগ্যবানরা বুদ্ধিমান শত্রু পায়, আমি পাইছি অশিক্ষিত আর গর্দভ শত্রু।
এইটা খোদাতালার কেমন বিচার?!!
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন
One thought on “সত্যের জোরে নয়, চেতনার জোরে মিথ্যাচার”
দাদা
এই বিষয়ে আপনার লেখা দুইটা আর্টিকেল ই পড়লাম,যা বুঝলাম তা হলঃ
বিষয়টা হয়েছে এমন যে, মনে করেন আপনার কোন বন্ধুর কারোর সাথে মারপিট হয়েছে,এখন এই বিষয়ে শালিশ/বিচার আচার হবে, কিন্তু শালিশে/বিচারে আপনার বন্ধুকে ডিফেন্স করার মত কেউ নেই, তাই তার অনুরোধে আপনি তাকে ডিফেন্স করতে গেছেন।কিন্তু সমস্যা টা হয়েছে এই জায়গাই ই যে আপনি যেহেতু ডিফেন্স করছেন তাই পাবলিক ভাবছে যে হয়ত আপনার উস্কানিতে/পরামর্শে আপনার বন্ধু মারপিট করছে। এমন নয় কি??