অভিজিৎ রায় আমার ফেইসবুক বন্ধু ছিলেন। গত বছর কোন এক সময়ে ধারাবাহিকভাবে মুলত বিদেশে অবস্থানরত তরুন নাস্তিক্যবাদীদের সাথে আমার কিছু একাডেমিক তর্কের প্রেক্ষিতে পর্যায়ক্রমে সকলের সাথেই ফেইসবুকের এই সম্পর্ক ছিন্ন করি, অভিজিৎ রায়ের সাথেও ফেইসবুকের সম্পর্কের ইতি ঘটে।
আমি অভিজিৎকে কখনো চোখের দেখা দেখিনি, তাঁর লেখার মাধ্যমেই তাঁকে যতটুকু চিনেছি। তরুন নাস্তিক্যবাদীদের সাথে আমার চিন্তার ভিন্নতা আছে, তার মুল কারণ আমি নাস্তিক নই, আমি অজ্ঞেয়বাদী; পাশাপাশি আমি তাঁদের চর্চার এবং চিন্তার প্রকাশের পথটাকে সঠিক মনে করিনা। এ সত্ত্বেও অভিজিতের বিপদে সাহায্য করার ইচ্ছায় ঢাকা মেডিক্যালে ছুটে যেতে আমি নৈতিক তাগিদ অনুভব করেছি।
কিন্তু গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ফিরে এসে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অভিজিতের মৃত্যুতে দেয়া স্ট্যেইটাসের নিচে কারো কারো যেই উল্লাস দেখেছি সেটায় আমি বিহ্বল এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছি। কী নিদারুণ মৃত্যুক্ষুধা কারো কারো মধ্যে।
বাংলাদেশে কেউ হেফাজত মরলে খুশী হয়, কেউ বিএনপি মরলে খুশী হয়, কেউ জামাত মরলে খুশী হয়, কেউ বিডিআরের অফিসার মরলে খুশী হয়, কেউ আওয়ামী লীগ মরলে খুশী হয়, কেউ নাস্তিক মরলে খুশী হয়, কেউ হিন্দু মরলে খুশী হয়, কেউ মুসলিম মরলে খুশী হয়, কেউ বাম মরলে খুশী হয়। কারণ আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করিনা। তাই সবার মৃত্যুতে বেদনাহত হওয়ার ক্ষমতা আমরা অনেকেই হারিয়ে ফেলেছি। আমরা মানুষকে ভালোবাসিনা, আমরা প্রাণের পক্ষে নই, প্রাণের সুরক্ষায় আমরা উৎসব করিনা; আমরা মৃত্যুর সেলিব্রেশন করি। আমরা আসলে জম্বি। ভেতরের মানুষটা মরে গেছে, অর্থহীন শরীর নিয়ে দিন কাটাই। মানুষ আমাদের কাছে জরুরী নয়, জরুরী “আদর্শ”। আমরা আমাদের তথাকথিত আদর্শের জন্য মানবতাকে ট্রেইড অফ করেছি। যেই আদর্শ মানুষকে ভালবাসতে শেখায় না, সেই আদর্শের মানুষকে দেবার কিছু নেই।
প্রত্যেকটা মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য মানবিক সত্তাকে শেয়ার করে, সেটার মর্যাদা হানী হলে সব মানুষের মর্যাদা হানী হয়। অভিজিতের মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে হলে নাস্তিক হওয়ার দরকার নেই, মানুষ হলেই যথেষ্ট।
প্রিয় দেশবাসী ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, নিহত হেফাজতি আর নিহত অভিজিতের রক্তের কোন তফাৎ নেই, ভালো করে দেখুন, দুজনেই ভিক্টিম, দুজনেই আপনার ভাই।