চারু মামার ক্যান্টিনের ভাড়া আর বিদ্যুৎ বিল দেয়ার বিষয়ে এক ধরনের অনীহা ছিল, সেটা আগেই বলেছি। উনার সম্ভবত একটা অধিকারবোধ ছিল যেই কারণে এইটা না দেয়ার একটা বৈধতা উনি খুজে পেতেন। ছাত্ররাও মনে করতো এই ভাড়া নেয়াটা ঠিক নয়। কিন্তু এই ভাড়াতো কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মাফ করতে পারেনা। এই মাফ পেয়েছিলেন তিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর কাছে থেকে। সে এক মজার বিষয়।
২০০০ সালে আমরা মিলেনিয়াম পুনর্মিলনী করছি। প্রধান অতিথি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বেশ কিছু সময় আমাদের সাথে আনন্দে কাটালেন। এর মধ্যেই কেউ একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব করলেন চারু মামার ক্যন্টিনের বকেয়া ভাড়া এই উপলক্ষে যেন সরকার থেকে মউকুফ করে দেয়া হয়। এমন উদ্ভট আবদার শুনে প্রধানমন্ত্রীর বিরক্ত হওয়ারই কথা, কিন্তু উনি বিরক্ত না হয়ে বলেছিলেন, একটা টোকেন পেমেন্ট করলে বাকিটা মন্ত্রণালয় থেকে মউকুফ করে দেয়া হবে। উনি কৌতুক করেই সাবধান বানী উচ্চারন করেছিলেন, এরপর থেকে যেন ভাড়া বাকী না পরে।
টোকেন পেমেন্টটা ছিল মনে হয় ২৫ হাজার টাকা। আর চারু মামার মোট বাকি যে কয় লাখ টাকা ছিল আল্লাই মালুম, কেউ ভয়েই সেই অঙ্কের কথা শুনতে চায়নি। ভাগ্যিস প্রধানমন্ত্রীও জানতে চাননি।
কিন্তু এই ২৫ হাজার টাকা তো চারু মামা দেবেন না। উনি এসে আমাদের বলতে লাগলেন, আমি ২৫ হাজার টাকা কই পাবো? আর আপনারা এতো কিছু করলেন ক্যান্টিনটা বিনা ভাড়ায় নেয়ার পারমিশন নিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে। চারু মামার উচ্চাশা তখন আকাশে ঠেকেছে। 😀
এবার ত্রাতা হয়ে আসলেন আমাদের মেডিক্যাল কলেজের একজন সাবেক ছাত্র, আমি উনার নাম বলছিনা, কিন্তু খুব বিখ্যাত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যবসায়ী। তিনি নগদে ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে দিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী, মাহমুদ হাসান স্যার এবং হাজার হাজার প্রাক্তন ছাত্রের উপস্থিতিতে মাইকে ঘোষণা করলেন যতদিন তিনি বেঁচে আছেন ততদিন ক্যান্টিনের ভাড়া মাসে ছয় হাজার টাকা উনি দিয়ে যাবেন। আমরা তুমুল হর্ষধ্বনি দিয়ে উনার বদান্যতাকে অভিনন্দিত করলাম।
পরপর তিন মাস চারু মামা নিয়মিত ভাড়ার টাকা পেলেন চতুর্থ মাসে চারু মামার ডাক পরলো ভদ্রলোকের অফিসে। চারু মামা গিয়ে দেখলেন ভদ্রলোকের সাথে আরো দুইজন রাজশাহী মেডিক্যালের স্বনামধন্য সাবেক ছাত্র। সেই ভদ্রলোক বললেন, মামা, মাসে মাসে এই টাকা নিয়ে কী করবেন; বরং আপনার দুই মেয়ে আছে তাঁদের বিয়ের সময় বিয়ের পুরো খরচটা আমার কাছে থেকে নিয়েন। সাথে মাথা নাড়লেন আমাদের দুই সাবেক ছাত্র। চারু মামার রাজী না হয়ে উপায় ছিলনা। সিনেমা অবশ্য তখনও শেষ হয়নি।
চারু মামার বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো সম্ভবত ২০১১ সালের শুরুতে। তিনি যথারীতি সেজেগুজে ভদ্রলোকের কাছে থেকে মেয়ের বিয়ের টাকা আনতে গেলেন। বাঙলা সিনেমায় বড়লোকের দরিদ্র স্বজনকে যেমন দুরদুর করে বড়লোকের দারোয়ান তাড়িয়ে দেয়। কিছুই না দিয়ে সেভাবেই তাড়িয়ে দেয়া হলো চারুমামাকে।
সেদিন অপমানিত হয়ে ফিরে এসে চারুমামা আমাকে ধরে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন। চারুমামার সেই কান্নার শব্দ এখনো আমার কানে বাজে।
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন