পটকা ফুটিয়ে, হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে ইয়ার দোস্তের সাথে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন, হাই ভলিউমে হিন্দি গান বাজাচ্ছেন; আর নিউ ইয়ার রেজোলুশন নিচ্ছেন; জেনে রাখুন এটা আপনার আমার কালচার নয়, এটা ইউরোপিয়েন কালচারও নয় এটা নিরেট খ্রিসচানিটি। আপনি খ্রিসচানিটি করুন, আমার আপত্তি নাই, কিন্তু জেনে বুঝে করুন। আধুনিকতা বা স্যেকুলার আচার মনে করে করবেন না। আমি এই প্রসঙ্গে নবীনচন্দ্র সেন আর রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বিতর্কের রেফারেন্স দিতে চাই।
উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু পরবর্তী শোকসভা’র আয়োজন করা হলে আয়োজকরা বঙ্কিম স্নেহভাজন কবি নবীনচন্দ্র সেনকে সভাপতি মনোনীত করেন। কিন্তু নবীন চন্দ্র শোকসভার আয়োজনকে পাশ্চাত্য ঘরানার বলে সভাপতিত্ব করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে নবীনচন্দ্র সেন স্মৃতিকথা ‘আমার জীবন’-এর ৫ম খন্ডে লিখেছেন:
“সভা-শ্রাদ্ধ গড়াইতে গড়াইতে এখন ইংরাজের অনুকরণে ‘শোক-সভা’ পর্যন্ত আরম্ভ হইয়াছে। বঙ্কিম বাবুর জন্য ‘শোক-সভা’ হইবে, রবি বাবু শোক-প্রবন্ধ পাঠ করিবেন, তাহার সভাপতিত্ব করিতে আমি আহূত হইয়াছিলাম। আমি উহা অস্বীকার করিয়া লিখিলাম যে, সভা করিয়া কিরূপে শোক করা যায়, আমি হিন্দু তাহা বুঝি না।…. ‘শোক-সভা’ সম্বন্ধে আমার উপরোক্ত মতের প্রতিবাদ করিয়া, রবি বাবুর ‘সাধনাতে এক প্রবন্ধ বাহির ‘হইয়াছিল।”
নবীনচন্দ্র সেন বলেছিলেন, আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতে মৃতের জন্য আমরা ব্যক্তিগত শোক করি, তাঁকে নিয়ে শোভাযাত্রা করি, মৃতের কীর্তির স্থানকে আমরা সংরক্ষণ করি ইতিহাসের আকর হিসেবে আর মৃতের স্মারক সংগ্রহ করি।
রবীন্দ্রনাথ নবীনচন্দ্রের মতের বিরোধীতা করে ‘শোক-সভা’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেন, প্রবন্ধটি ‘সাধনা’র জ্যৈষ্ঠ ১৩০১ সংখ্যায় ছাপানো হয়। রবীন্দ্রনাথ তাতে ‘য়ুরোপীয়তা নামক মহাদ্দোষে দুষ্ট’ বলে শোকসভা করার প্রথাকে নিন্দা করা উচিত নয় বলে মত দেন। তিনি বলেন:
“যাঁহারা বঙ্কিমের বন্ধুত্ব সম্পর্কে আপনাদিগকে গৌরবান্বিত জ্ঞান করেন এমন অনেক খ্যাতনামা লোক সভাস্থলে শোক প্রকাশ করা কৃত্রিম আড়ম্বর বলিয়া তাহাতে যোগদান করিতে অসম্মত হইয়াছেন এবং সভার উপযোগীগণকে ভৎসনা করিতেও ক্ষান্ত হন নাই। এরূপ বিয়োগ উপলক্ষ্যে আপন অন্তরের আবেগ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করাকে বোধ করি তাঁহারা পবিত্র শোকের অবমাননা বলিয়া জ্ঞান করে…যেমন আমাদের দেশে পিতৃশ্রাদ্ধ প্রকাশ্যে সভায় অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে এবং প্রত্যেক পিতৃহীন ব্যক্তির পিতৃশোক ব্যক্ত করা প্রকাশ্য কর্তব্যস্বরূপে গণ্য হয় তেমনি পাব্লিকের হিতৈষী কোনো মহৎ ব্যক্তির মৃত্যুতে প্রকাশ্য সভায় শোক জ্ঞাপন একটা সামাজিক কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত।….তাঁহারা বঙ্কিমের নিকট হইতে কেবলমাত্র উপকার পান নাই, বন্ধুত্ব পাইয়াছেন, তাঁহারা কেবল রচনা পান নাই, রচয়িতাকে পাইয়াছেন।….তাঁহাদের বন্ধুকে কেবল তাঁহাদের নিজের স্মরণের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিলে যথার্থ বন্ধু ঋণ শোধ করা হইবে না।”
রবীন্দ্রনাথ আধুনিক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যখন মারা গেলেন নবীনচন্দ্র সেন যা যা বলে গিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পরে স্বতর্স্ফুতভাবে তাই তাই ঘটলো। যেমন একটা শোভাযাত্রা হল, জোড়াসাকো ঠাকুরবাড়ি আমাদের পরিদর্শনের স্থান হল। আর স্মারকের কথা নাই বলি, রবীন্দ্রনাথের চুল দাড়ি যা ছিল তা শোভাযাত্রার মানুষেরা স্মারক হিসেবে ছিড়ে ছিড়ে নিয়েছিল। বেচে থাকতে যেই কালচারকে তিনি অতিক্রম করার বাসনা করেছিলেন মৃত্যু তাঁকে সেই সংস্কৃতির স্বাদ পাইয়ে দিয়েছিল।
আপনি কি এবার ভাববেন, আপনি আসলে কী উদযাপন করছেন? আর কেনই বা করছেন?
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন