আমি একটা লেখায় লিখেছিলাম “ডাব পাকলে যেমন নারকেল হয় তেমন ছাত্র ইউনিয়ন পাকলে আওয়ামী লীগ হয়”। কথাটায় ব্যঙ্গ আছে, শ্লেষ আছে, কিছুটা হতাশাও আছে। কয়েকদিন আগে সাবেক ছাত্র ইউনিয়নের একটা সভায় একজন অগ্রজ ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ডায়াসে দুঃখ করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, “আমাদের সব লোকজন বড় দলে চলে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগে গেলে দুঃখ ছিল না, কিন্তু বিএনপিতেও যাচ্ছে।“ বক্তৃতা শেষ হলে উনাকে আমি উঁচু গলায় ডেকে পাশে বসালাম। সকলে প্রমাদ গুনলেন এই বোধ হয় একটা সিন ক্রিয়েট হয়। আমি শান্ত ভাবেই বললাম, এই যে আপনি বললেন আওয়ামী লীগের গেলে দুঃখ হত না বিএনপিতে গেলে দুঃখ হচ্ছে, এটা কেন? এই দুই দলের তফাৎ কী? দুটোই ত বুর্জোয়া দল। উনি বললেন কেন? তফাৎ নাই, এই যে একটা দল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। আমি বললাম,, ভাই, আপনি তো বামপন্থী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে দলকে বিচার করতে পারেননা। আপনি বিচার করবেন শ্রেণী চরিত্র দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে একটা বিরাট ঘটনা সন্দেহ নাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কি আপনার শেষ গন্তব্য? একটা বুর্জোয়া দলে বামপন্থী কর্মী জগ দেয়াটাই একটা মহা বিপর্যয় সেখানে আপনি একটায় খুশী আরেকটায় বিষণ্ণ কেন? সেদিন আলোচনা আর আগায়নি। তবে আমি বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি কেন বুর্জোয়া দলে পতিত হলে বামপন্থীরা লজ্জিত না হয়ে আনন্দিত হয়?
এই কারণটা লুকিয়ে আছে বামপন্থীদের রাজনইতিক গ্রুমিং এ। সম্ভবত বাংলাদেশ ই একমাত্র দেশ যেখানে মার্ক্স না পড়েই একটা মার্ক্সবাদী দাবী করা দলের প্রধান নেতা হওয়া সম্ভব (বাসদের খালেকুজ্জামানের মার্ক্স পাঠ না করার স্বীকারোক্তি দেখুন)। মার্ক্স পাঠ বাম দলগুলোতে নিরুৎসাহিত করা হয়। যদি শীর্ষ নেতাই মাক্স পাঠ না করে থাকেন তাহলে তিনি মাক্স পাঠ দলের ভেতর উৎসাহিত করতে পারেন না। সেটাই হয়েছে। যদি কেউ পাঠ করতে চান তাঁর কপালে জোটে “আঁতেল” উপাধি। কিছু দিনের মধ্যেই রটে যাবে তাঁর নামে দুর্নাম, “কাজের বেলায় নাই, আছে খালি তত্ত্ব নিয়ে।“ চতুরভাবে ফয়েরবাখ সম্পর্কিত মার্ক্সের থিসিস স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে, “এতকাল ধরে দার্শনিকেরা কেবল দুনিয়াকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যাই করে গেছেন, আসল কাজটা হলো একে বদলানো।“। তাই তত্ত্বের কচকচানি দরকার নেই দরকার হচ্ছে বিপ্লবের জন্য কাজ করা, সংগ্রাম ও সংগঠন করা। কিন্তু সেই বিপ্লবটা কী? সেই বিপ্লবের চরিত্র কী হবে? কোন লক্ষ অর্জনের জন্য বিপ্লব? শত্রু মিত্র কীভাবে চিহ্নিত হবে? সেই জ্ঞানটা আসবে কীসের ভিত্তিতে? এটা থাকবে নেতার জিম্মায় জিনি দাবী করবেন নিজেকে মার্ক্সবাদী কিন্তু নিজে মার্ক্স পড়বেন না, কাউকে পড়তেও দিবেন না। পড়তে পারবে কী? পড়বে কিছু চোথা, মানে মার্ক্সের কথা শুনবে কিছু হর্সেস মাউথের কাছে থেকে, তাঁরা যেটাকে মার্ক্স বলে গেলাবেন সেটাই মার্ক্সবাদ বলে মনে করা হবে। এর ফল হয়েছে ভয়ানক। বাংলাদেশের বাম কর্মীদের মধ্যে মার্ক্স অনুপস্থিত, মার্ক্সিয় বিশ্লেষণের পদ্ধতি অনুপস্থিত, মার্ক্স যেটার পিছনে সারা জীবন জ্বেহাদ করেছেন সেটাকেই মার্ক্সবাদ বলে ধরে নিয়ে বসে আছেন এ বামপন্থীরা। ইউরোপিয়ান এনলাইট্মেন্ট কেই মানব মুক্তির পথ চূড়ান্ত পথ ধরে নিয়ে মুলত বুর্জোয়া ভাবাদর্শকেই লালন করছেন। এনলাইট্মেন্টের স্যেকুলার বয়ান, বিশেষ করে রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করার কর্মসূচীকে চূড়ান্ত প্রগতিশীল বলে ধরে নেয় তাঁরা। কখনো জানেনি, এটা একটা বুর্জোয়া এজেন্ডা। তাঁদের মাথাতেও আসেনা এনলাইটেন্মেন্ট কে অতিক্রম করে যাওয়াটা মার্ক্সবাদীদের কাজ। মার্ক্স যে ফয়েরবাখকে নাকচ করেছেন সেই ফয়েরবাখের বস্তুবাদ কেই মার্ক্স ভেবে বসে আছেন। যেই প্রুধো কে মাক্স নাচক করেছেন সেই নৈরাজ্যবাদীদের গুরু প্রুধোর অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা সমাজতন্ত্রের লক্ষ বলে ধরে নেয়। এর ফলে পরিণত বয়সে তিনি বুর্জোয়াদের সাথেই চিন্তার নৈকট্য অনুভব করেন। এবং দেখেন যেই আদর্শে এতদিন বিশ্বাস স্থাপন করে এসেছেন সেই আদর্শের সাথে বুর্জোয়া আদর্শের কোন বিরোধ নেই। সেকারণেই ব্যক্তিগতভাবে দলত্যাগ করে বুর্জোয়া দলে যোগ দিলে আদর্শচ্যুতির গ্লানিতে ভোগেন না এমনকি দলকে বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগ দিলেও দলের ভিতরে কোন প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনা।
বুর্জোয়া দলে নিজের পতনে আনন্দিত হন, গৌরব বোধ করেন। যেমন গাছপাকা নারকেল বৃন্তচ্যুত হওয়াকেই মোক্ষ বলে ধরে নেয়। তাই একসময় টুপ করে বুর্জোয়া দলে পতিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন তাঁরা।