জনাব মাসুদ রানা ঠিক “ভক্তি আন্দোলনঃ ফরহাদ মজহারের লেখার সূত্রে কিছু কথা” শিরোনামে ফেইসবুকে একটা লেখা প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তিনটি দাবী করেন। আমি মাসুদ রানার বয়ানেই আবিকৃত ভাবে সেই দাবী গুলি কপি পেস্ট করলাম।
(১) নদিয়াতে চৈতন্যের আন্দোলনটি ছিলো একটি ভক্তি আন্দোলন।
(২) চৈতন্যের আন্দোলনটি ছিলো সর্বভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের একটি ভ্যারিয়েণ্ট।
(৩) সামরিক শক্তিতে ও মানবিক আবেদনে সুপেরিয়র ও সর্বগ্রাসী ইসলামিক সাম্যবাদের মুখে বিধ্বস্ত প্রায় হিন্দু সমাজের আত্মপরিচয় ধরে রাখার একটি আত্মরক্ষামূলক আন্দোলন।
প্রথম প্রশ্নে আমি আমার পূর্বাবস্থানেই আছি। ফরহাদ মজহার কি বললেন সেটায় আমার কিছুই যায় আসেনা। ফরহাদ ভাই যেটা চিন্তা করবেন সেটাই আমাকে গ্রহণ করতে হবে এমন মাথার দিব্যি আমি দেইনি। আমি কেন চৈতন্যয় আন্দোলনকে শুধু “ভক্তি” আন্দোলন বলতে নারাজ সেটা আগের লেখায় ব্যাখ্যা করেছি। ফরহাদ মজহারের কথায়,
“কেন শ্রীচৈতন্য এই প্রকার ‘অচিন্ত্যভেদাভেদ’ তত্ত্বে এসেছিলেন তা নদিয়ার বর্তমান ভাবান্দোলনের আলোকেই বুঝতে হবে। এরপর দেখা দরকার ফকির লালন শাহ কিভাবে, কতোটুকু এই ভাব বহন করেছেন, এবং কোথায় তিনি আলাদা হয়ে নতুন ভাবের জগত তৈরি করেছেন। এই দিকটি স্পষ্ট না হলে নদিয়ার ভাবান্দোলনের সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব চর্চার – অর্থাৎ নদিয়ার সঙ্গে বৃন্দাবনী গোস্বামীদের মিল ও ফারাক শনাক্ত করবার শর্ত তৈরি হবে না। কিম্বা রসতত্ত্ব থেকে ভাবের চর্চা অবধি বাংলার ভাবান্দোলনের যে অভিযাত্রা তার পথরেখা, বাঁক ও মোড়গুলো আমরা আরো ভাল ভাবে বুঝব।“
ফরহাদ মজহার স্পষ্টভাবেই উপরের প্যারায় “ভাবান্দোলন” শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এখানে তিনি ফারাকের জায়গাও স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণ ভারতের ভক্তি আন্দোলনের সাথে গুলিয়ে ফেলার সমস্যা থেকে বাংলার ভাবকে রক্ষার জন্যই আমার এই অবস্থান। আমি নদিয়া থেকে লালনে পৌছাতে চাই, সেই রাস্তাটা আমাকেই পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি গতকাল। আমি প্রমাণ করেই দিয়েছি চৈতন্যকে সর্বভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের ভ্যারিয়েন্ট বলে মানাটা নিজস্ব পছন্দের বিষয় এবং যে বিষয়ে একাডেমিক্যালি বিতর্কের মীমাংসা হয়নি সেই বিতর্কে আপনি কোন পক্ষ নেবেন সেটা আপনার রাজনীতি। তর্কে জেতার জন্য সেটা আপনি করুন, আপনি ওই পক্ষেই থাকবেন সেটা জানাই ছিল। আপনি বাঙলার চিন্তাকে অবমুল্যায়িত করে যদি আনন্দ পান, আপনার সেই ব্যক্তিগত সুখভোগে বাধা দেয়ার অধিকার আমার নেই।
এবার ভক্তি আন্দোলনকে, “সামরিক শক্তিতে ও মানবিক আবেদনে সুপেরিয়র ও সর্বগ্রাসী ইসলামিক সাম্যবাদের মুখে বিধ্বস্ত প্রায় হিন্দু সমাজের আত্মপরিচয় ধরে রাখার একটি আত্মরক্ষামূলক আন্দোলন।“ বলে আপনি যেই বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন সেটা খণ্ডানোর পালা।
মাসুদ রানার শেষ পয়েন্টটি একটি ভ্রান্ত এবং অপরিপক্ক চিন্তা। ভারতে মুসলিম শাসকেরা আসার অনেক আগেই ভারতে ভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব ও বিস্তার হয়েছে। ভক্তি আন্দোলন চরিত্রগতভাবে হিন্দু ধর্মের সংস্কার আন্দোলন। ভক্তি আন্দোলনের মুল লক্ষ্য ছিল হিন্দু ধর্মের জাতপাতের উচ্ছেদ আর ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রাচারের হাত থেকে বাঁচা। ভক্তি আন্দোলনের জন্ম এবং উদ্ভবের ইতিহাস অতি প্রাচীন। এমনকি ইসলাম ধর্মের ভারতে আসা তো দুরের কথা ইসলাম ধর্মের মহানবীর নবুয়্যাত প্রাপ্তির অনেক আগেই ভক্তি আন্দোলনের সুত্রপাত হয় ভারতে। মহাভারতে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকে হেলিওডেরাস নামে এক গ্রীক বৈষ্ণবের কথা জানা যায়।
দক্ষিণ ভারতের তামিলদের মধ্যে আলোয়ার সম্প্রদায়ের রচনার এক দীর্ঘদিনের ভক্তি সাধনার প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। এর মধ্যে নবীনতম রচনা গুলি অষ্টম ও নবম শতকের। এই সময়ে মুসলিমরা ভারতে এসে পৌঁছায়নি।
ভক্তি আন্দোলনের বৌদ্ধিক আর দার্শনিক ভিত্তিভুমি তৈরি করে দিয়েছিলেন রামানুজ (১০১৭-১১৩৭)। রামানুজ ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশাতেও ভারতে মুসলিম শাসন শুরু হয়নি। মাসুদ রানার কথা মেনে নিলে এটাই ধরতে হবে রামানুজের ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল যা দিয়ে তিনি আগেই ভারতে মুসলিম আগমনের কথা জানতে পেরেছিলেন তাই ভক্তি আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি তিনি আগেই তৈরি করে দিয়ে গেছেন।
কাশ্মীরেও শৈব ভক্তি আন্দোলন প্রবল ছিল শৈব দর্শনের সবচেয়ে খ্যাতিমান কাশ্মীরি ব্যাখ্যাতা হলেন অভিনবগুপ্ত। তিনি ছিলেন একাদশ শতকের মানুষ। সেই সময়ে কি ভারতে মুসলমান শাসন শুরু হয়েছিলো?
নদীয়ার ভাবান্দোলনের সময় অবশ্য বাঙলায় মুসলিম শাসন। তবে সেই সময়ের কথাও যদি বলি তবে দেখবো সেই মুসলিম শাসনের চরিত্র মোটেই হিন্দু বিদ্বেষী নয়। বরং শ্রী চৈতন্যর সামনে সকল প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে ব্রাহ্মণ সমাজ। এমনকি কাজির কাছে নালিশ জানানো এবং কাজিকে ফুসলিয়ে কীর্তনের উপর হামলা করেইয়েছে ব্রাহ্মণেরাই। তাঁদের অভিযোগ ছিলো হিন্দু ধর্মকে বিনষ্ট করছে চৈতন্য তাই যেন কাজি হস্তক্ষেপ করেন। এই ঘটনার পরে কাজির সাথে চৈতন্যের একটা মুখোমুখি আলাপ হয়। কাজি সবিস্তারে ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রের কথা চৈতন্যকে বর্ণনা করে। বস্তুত এর পর থেকে শ্রী চৈতন্য তাঁর আন্দোলনে বাঙলার সুলতানের প্রত্যক্ষ সহায়তা পেয়েছেন। শ্রী চৈতন্যর সময়ে বাঙলায় চলছিল হসেন শাহীর আমল সেই সময়ে বাঙলার হিন্দুরা খুব সুখেই ছিল। উনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হলেও হিন্দু প্রজাদের কাছে দারুন জনপ্রিয় ছিলেন। হিন্দুরা উনাকে “নৃপতি তিলক” উপাধি দিয়েছিলেন।
সমসাময়িক হিন্দু কাব্যে উনাকে কৃষ্ণের অবতার বলে সন্মান জানানো হয়েছিল।
“নৃপতি হুসেন শাহ হয় মহামতি।
পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।।
অস্ত্রেশস্ত্রে সুপণ্ডিত মহিমা অপার।
কলিকালে হবু যেন কৃষ্ণ অবতার।।“
এমন একটা দারুণ উদার সময়ে মাসুদ রানা কীভাবে বাঙলায় হিন্দু ধর্মকে বিধ্বস্ত হতে দেখলেন আত্মরক্ষাই বা কোথায় দেখলেন?
দোহাই ও টোকাটুকিঃ
১/ ক্ষিতিমোহন সেন, হিন্দু ধর্ম, আনন্দ পাবলিশার্স
২/ Andrea Nippard. “The Alvars
৩/ Ancient India: Collected Essays on the Literary and Political History of Southern India”, Sakkottai Krishnaswami Aiyangar
৪/ চৈতন্যদেব, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরী, পত্রলেখা প্রকাশনী।
৫/ মহাভারত আদি পর্ব