ধর্ম নিরপেক্ষতাঃ বুর্জোয়ার সার্কাস দেখায় বাঙলার বামপন্থীরা

ধর্ম নিরপেক্ষতা ইউরোপে ১৭ এবং ১৮ শতকে প্রায় ২০০ বছর ধরে চলা বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শিক রাজনৈতিক সংগ্রাম এনলাইটেনমেন্টের উপজাত। পুঁজিবাদি ব্যবস্থায় পুঁজিই হয়ে ওঠে নতুন ঈশ্বর; নতুন ধর্ম। পুঁজিবাদ তাঁর আগের যে সব ধর্ম নীতি নৈতিকতা তার বিকাশ আর স্ফিতির চরিত্রের সাথে কম্প্যাটিবল মনে করেনা তাকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে হয় নির্বাসন দেয় অথবা বদলে ফেলে। এই কাজটাই করে সে এনলাইটেনমেন্টের নামে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যক্তিগত স্পেসে তার স্থান নির্ধারিত করে দেয়। এটাই মুল কথায় স্যেকুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতা। ইউরোপের বুর্জোয়াদের এই কাজটা করতে হয়েছিলো কারণ সামন্তবাদি সমাজ ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভু আর চার্চ একসাথে সামন্ত সমাজে প্রভুত্ব করতো। চার্চকে ক্ষমতার মসনদ থেকে সরানোটা নতুন প্রভুত্তকামি পুজিপতি শ্রেণীর জন্য জরুরী ছিলো। তাই নতুন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ধর্ম নিরপেক্ষতা ধর্মকে হঠিয়ে দিয়ে নিজেই হয়ে ওঠে পুঁজিবাদের ধর্ম। এই কাজটি করতে একটি দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে ইউরোপকে। ধর্মের সাথে এই ন্যুনতম রাজনৈতিক ফয়সালা করতে ইউরোপকে অনেক পথ পারি দিতে হয়েছে।

প্রাচ্যের ধর্মের ইতিহাস ইউরোপের মতো নয়। ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতার সাথে একসাথে মিলে জনতার উপর প্রভুত্ব করেনি। বরং ধর্মভাব রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রেরণা ছিল। যেমন হয়েছে এই অঞ্চলের সমস্ত কৃষক বিদ্রোহে। পাকিস্তানী শাসকেরা ধর্মের নামে ১৯৭১ এ যেই বর্বর ও নির্মম আচরণ করেছে বাঙালিদের সাথে সেই সময়টুকু আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বাদ দিলে ধর্ম নিপীড়কের অস্ত্র হিসেবে এই অঞ্চলে কখনো কাজ করেনি।

ধর্ম নিরপেক্ষতার এই প্রপঞ্চ একটি বুর্জোয়া ভাবাদর্শ সেটায় নিশ্চয় কোন দ্বিমত নেই। যদিও এই রেডিমেইড ভাবাদর্শকে কোন দীর্ঘ লড়াই ছাড়াই এই দেশের বুর্জোয়ারা ডিক্রি করে চাপিয়ে দিয়ে বাস্তবায়ন করতে চায়। এই বুর্জোয়া ভাবাদর্শকে বামপন্থীরা কীভাবে গ্রহণ করবে, সেটার বিচার মার্ক্স করে গেছেন। দুঃখজনক ভাবে মার্ক্সের দেখানো পথে ধর্মের এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নটিকে বাংলাদেশের বামপন্থীরা হাঁটেন না। বরং ধর্ম ও ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে ফয়েরবাখের যেই অবস্থানের সমালোচনা মার্ক্স করেছিলেন সেই সমালোচনা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের বামপন্থীরা ফয়েরবাখের পথে হাঁটেন। ফয়েরবাখ প্রসঙ্গে মার্ক্সের চার নম্বর থিসিসটা যদি আমরা দেখি তবে বাংলাদেশের বামপন্থীদের বিচ্যুতিটা আমরা ধরতে পারবো।

ফয়েরবাখ সংক্রান্ত মার্ক্সের চার নম্মব থিসিস।

“Feuerbach starts off from the fact of religious self-estrangement [Selbstentfremdung], of the duplication of the world into a religious, imaginary world, and a secular [weltliche] one. His work consists in resolving the religious world into its secular basis. He overlooks the fact that after completing this work, the chief thing still remains to be done. For the fact that the secular basis lifts off from itself and establishes itself in the clouds as an independent realm can only be explained by the inner strife and intrinsic contradictoriness of this secular basis. The latter must itself be understood in its contradiction and then, by the removal of the contradiction, revolutionised. Thus, for instance, once the earthly family is discovered to be the secret of the holy family, the former must itself be annihilated [vernichtet]theoretically and practically.”

ফয়েরবাখ ধর্মীয় আত্নবিচ্যুতির জায়গা থেকে শুরু করেন, শুরু করেন দুনিয়ার একদিকে ধর্মীয় জগৎ আর অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ জগতএই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া থেকে। তাঁর কাজ হোল ধর্মের জগতকে তাঁর ধর্ম ভিত্তির মধ্যে মীমাংসা করা। কিন্তু সেই ধর্ম নিরপেক্ষ ভিত্তিও নিজের কাছ থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে সেই উচু মেঘের মধ্যেই নিজেকে একটি স্বাধীন জগত হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করে যাকে একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতরকারই ফাটল তাঁর স্ববিরোধিতা দিয়েই শুধু ব্যাখ্যা করা যায়। তাহলে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে তাঁর নিজের জায়গা থেকে বুঝতে হবে তাঁর নিজেরই স্ববিরোধিতা দিয়ে এবং তৎপরতার মধ্য দিয়ে বৈপ্লবিকতার স্তরে বদলিয়েদুই দিক থেকেই। অতএব উদাহরন হিসেবে বলা যায়, যদি পার্থিব পরিবারই পবিত্র পরিবারের (Holy family) , আসল সত্য বলে আবিষ্কৃত হয় তাহলে কাজ হোল পার্থিব পরিবারকেই তত্ত্বে চর্চায় ধ্বংস করা।

ফয়েরবাখ আমাদের বামপন্থীদের মতোই একদিকে ধর্ম আরেকদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা এই চিরন্তন দ্বন্দ্ব নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করেন। মার্ক্স বলছেন এটা ভুল। কারণ ধর্ম যেই সমাজে জন্ম নেয় নিরপেক্ষতাও সেই একই সমাজে জন্ম নেয়। তাই পরস্পরকে পরস্পরের বিপরীত চিন্তা করাটাই অর্থহীন। এভাবে চিন্তা করে ফয়সালা করতে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে ধর্মের ভিত্তির মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতার পর্যালোচনা। খেয়াল করুন, ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজকেও কিন্তু একটি ধর্মতাত্ত্বিক সমাজ বলেছেন মার্ক্স। ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজকেও আধ্যাত্মিক বলছেন মার্ক্স। এবং ধর্মের বিপরীতে ধর্ম নিরপেক্ষতা এমন সরল ন্যারেটিভ মার্ক্স মানছেন না। মার্ক্সের প্রস্তাব হচ্ছে যেই সমাজ এই দুই আধ্যাত্মিক অবস্থার সৃষ্টি করে সেটার ভিত্তিকে অপসারন করা যেন এই দুই আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন না হয় মানুষের। এটাই একজন প্রকৃত বামপন্থীর অবস্থান হতে পারে। এবং একজন প্রকৃত বামপন্থীর কাছে ধর্ম নিরপেক্ষতা কখনো মঞ্জিলে মকসূদ হতে পারেনা। ধর্ম নিরপেক্ষতার মধ্যে ধর্মের ফয়সালাও নেই। আছে এক অমীমাংসা।

এই থিসিসে মার্ক্স একটা গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার হদিস দিয়েছেন। তাঁর মতে ধর্ম মানে প্রতিক্রিয়াশীল আর ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে প্রগতিশীল এই কথা তিনি মানেন নি। তাহলে বাংলাদেশের বামপন্থীরা কেন ধর্মের বিপরীতে ধর্ম নিরপেক্ষতা দিয়ে ধর্মের ফয়সালার প্রস্তাব করে? এই প্রশ্নের উত্তর শিরোনামে আছে। এটা বুর্জোয়ার সার্কাস, সেই সার্কাসকেই নিজের খেলা ভেবে বামপন্থীরাও এই একই সার্কাস দেখিয়ে যাচ্ছেন দেশবাসীকে দীর্ঘদিন থেকে। বড়ই প্যাথেটিক!!!

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter