১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের ভয়াবহ দাঙ্গার কথা আমরা জানি। ঐ দিন মুসলিম লীগ ‘ডাইরেক্ট একশন’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। কর্মসূচিটি কার বিরুদ্ধে ছিল? মুসলিম লীগের বক্তব্য হলো- ওটা ছিল বিট্রিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট একশন। বৃটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে, ভারতবর্ষর দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায় করতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা উলটো বুঝিয়ে বলল, “এই কর্মসূচি হিন্দুদের বিরুদ্ধে”। বংলাদেশের কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংহও মনে করেন, ঐ কর্মসূচি ছিল হিন্দুদের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন মুসলিম লীগের মাঠের কর্মী- প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তের ঘটনার সাথে যুক্ত। ভয়াবহ দাঙ্গার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তার বক্তব্য আর মনি সিংহের বক্তব্যের তফাৎ আকাশ-পাতাল। মনি সিংহের অনুসারীরা নিশ্চয়ই মনে করেন, ঐ সংগ্রাম ছিল হিন্দুদের বিরুদ্ধে যেমনটা মনে করে কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভা। কংগ্রেস আর হিন্দুমহাসভার বয়ানের সাথে কীভাবে একজন কমিউনিস্ট নেতার বয়ান একেবারে খাপে-খাপ মিলে যায়?
এবার দুই নেতার নিজের বয়ানে শুনুন ১৬ই আগস্টের ঘটনার দুই ভিন্ন বয়ান। প্রথমটা অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে পরেরটা জীবন সংগ্রাম থেকে।
“২৯ জুলাই জিন্নাহ সাহেব অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভা বোম্বে শহরে আহ্বান করলেন। অর্থের অভাবে আমি যেতে পারলাম না। জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ ডাইরেক্ট একশন ডে’ ঘোষণা করলেন। তিনি বিবৃতির মারফত ঘোষণা করেছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে এই দিবস পালন করতে। ব্রিটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে তিনি এটা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায়ে বদ্ধ পরিকর। কোনওরকম বাধাই তারা মানবে না। কংগ্রেস ও হিন্দু মহসভার নেতারা এই ‘ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন।
আমাদের আবার ডাক পড়ল এই দিনটা সুষ্ঠভাবে পালন করার জন্য। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে সভা করলেন। আমাদের বললেন, “তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি।” আমরা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে বের হয়ে পড়লাম। হিন্দু মহল্লায় ও মুসলমান মহল্লায় সমানে প্রপাগান্ডা শুরু করলাম। অন্য কোন কথা নাই, পাকিস্তান আমাদের দাবি। এই দাবি হিন্দুর বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। ফরোয়ার্ড ব্লকের কিছু নেতা আমাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি শুনে মুসলিম লীগ অফিসে এলেন এই দিনটা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হিন্দু মুসলমান এক হয়ে পালন করা যায় তার প্রস্তাব দিলেন। আমরা রাজি হলাম। কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রপাগান্ডার কাছে তারা টিকতে পারল না। হিন্দু সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিল এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে।“
অসমাপ্ত আত্মজীবনী শেখ মুজিবুর রহমান, ইউ পি এল, পৃষ্ঠা ৬৩
“১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগস্টকে মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। সংগ্রাম হিন্দুর বিরুদ্ধে। কলকাতা এবং অন্যান্য জায়গায় সে সময় বীভৎস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সুত্রপাত হয়।“
জীবন সংগ্রাম, মনি সিংহ, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী পৃষ্ঠা ৮৪-৮৫
সিপিবি ১৬ই আগস্ট সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যকে কি গ্রহণ করে নাকি করেনা? সিপিবি নেতা মনি সিংহ যে বয়ান দিয়েছেন তা হিন্দু মহাসভার বয়ানের সাথে হুবহু মিলে যাওয়াটা কাকতালীয় নয়। সিপিবি ঐতিহাসিকভাবে এই ভুখণ্ডে হিন্দু স্বার্থের রাজনীতি করেছে। হিন্দু রাজনীতির যে বয়ান সেই বয়ান সবসময় সিপিবির মুখে শোনা যায়। নামে যাই হোক সিপিবি আসলে হিন্দু মহাসভা আর কংগ্রেসের বাংলাদেশী সংস্করণ বললে কি অতিকথন হবে?
সিপিবি নিজে কী ব্যাখ্যা দিতে চায়, আমরা শুনতে চাই। বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চার জন্য এটা জানাটা জরুরী।
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন