হিন্দু ধর্মের অসংখ্য দেবদেবী এবং একেক অঞ্চলে একেক দেবদেবীর আরাধনা এক বিভ্রম সৃষ্টি করে। বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে হিন্দু ধর্মে বহু ঈশ্বর। এই ধারনাটি ভুল। হিন্ধু ধর্মে ব্রহ্মই সত্য, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়; একমেবাদিতিয়ম। তবে বহু দেবতার রহস্য কী? সেই বিষয়টিই আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
হিন্দু ধর্মে দেবদেবী তিন ধরণের
১/ বৈদিক দেবদেবী
২/ এপিক বা মাহকাব্ব্যিক দেবদেবী (মহাভারত এবং রামায়ন থেকে যাদের দেবতা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে)
৩/ পৌরাণিক দেবদেবী
বৈদিক আর্যরা ছিল প্রকৃতি পুজক। তাই বৈদিক দেবতারা এক একটা পার্থিব বস্তুক্র বা পার্থিব প্রাকৃতিক অবস্থার প্রতীক। প্রত্যেক দেবতা তাই এক একটা পার্থিব অবস্থা বা বস্তুর চৈতন্যসত্তা বা অধিষ্ঠাতা। বস্তুজগতকে উপলক্ষ করেই মানুষের মনে ভাবের উদ্রেক হয়, এবং সেই ভাব ক্রমে বস্তুকে অতিক্রম করে ভাবসর্বস্ব হয়ে ওঠে। বস্তুময় জগত থেকে ভাবের উদ্রেক এবং পরে সেই ভাবময় সত্তা থেকে বস্তুজগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্যই দেবদেবীর রূপকল্পের প্রয়োজন হয়। দেবতা উদ্দিষ্ট নয় উদ্বোধক। যেই উদ্বোধকের হাত ধরে উদ্দিষ্ট ভাবের উদয় হয়।
বৈদিক ঋষিরা সেইজন্যই প্রকৃতি জগতের বস্তুকেই তাৎক্ষণিক দেবতা বলে গ্রহন করেছেন। তাই আকাশ, জল, চন্দ্র, সূর্য সকলেই বৈদিক দেবতা।
বৈদিক দেবতাসমুহকে একটা ছকে আনলে ঠিক এভাবে দেখানো যায়।
বেদের দেবতা মণ্ডলী স্থানভেদে তিনভাবে বিভক্ত। যেমন, ভূলোকের দেবতাগণ- অগ্নি, অপ (জল), পৃথিবী ও সোম। অন্তরীক্ষ লোকের দেবতাগণ- ইন্দ্র, বায়ু, রুদ্র, মরুত, অপাং নপাৎ (বিদ্যুৎ), পর্জন্য। দ্যুলোকের দেবতাগণ- সূর্য, মিত্র, বরুণ, দ্যুঃ, পুষা, সবিতা, আদিত্য, অশ্বিযুগল, ঊষা ও রাত্রি। দ্যুলোক হচ্ছে সেই স্থান যেখানে নক্ষত্রসমুহ বিচরণ করে। আর অন্তরিক্ষ হচ্ছে দ্যুলোক ও অন্তরিক্ষের মধ্যবর্তী স্থান। এই তিন স্থানের দেবতাদের মধ্যে একজন হলেন সেই স্থানের প্রধান দেবতা বা অধিষ্ঠাতা। আর অন্যান্য দেবতারা হলেন তাঁরই ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি। ভূলোকের দেবতাদের মধ্যে অগ্নি হলেন মুখ্য, অন্তরিক্ষে ইন্দ্র বা বায়ু আর দ্যুলোকের সূর্য। তাহলে অগ্নি, বায়ু ও সূর্য হচ্ছে প্রধান দেবতা।
অগ্নি প্রসঙ্গে বলা হয় অগ্নি দ্যুলোকে উৎপন্ন কিন্তু অন্তরিক্ষে ও ভুলোকে সর্বত্রই বিরাজমান। বেদ মতে মাতরিশ্বা প্রমিথিউসের মতো অগ্নিকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। অগ্নি দেবতার আরেক নাম প্রমন্থ, কী অদ্ভুত মিল প্রমিথিউসের সঙ্গে।
খুব কৌতূহল উদ্দীপক বিষয় হচ্ছে বেদে অগ্নিকেই সূর্য আবার সূর্যকেই অগ্নি বলা হয়েছে। অগ্নি বায়ুর (ইন্দ্রের) সংস্পর্শে এসে লেলিহান শিখায় রুপান্তরিত হয়। সেই লেলিহান শিখায় হব্যের আহুতি দিতে হয় যজ্ঞের সময়। অগ্নির শিখাকে বেদে বলা হয়েছে অগ্নির মুখ। ঋগ্বেদে বলা আছে সূর্য থেকেই প্রাণের ধারা পৃথিবীতে প্রবাহিত হয়। তাহলে শেষ বিচারে প্রাণের ধারা যেই সূর্য থেকে প্রবাহিত হয় সেই সূর্যই বৈদিক দেবতাদের উৎস। বৈদিক দেবতার ধারণার মুলে আছে পৃথিবীর প্রাণের সাথে অসীমের সম্পর্ক। যেই প্রপঞ্চর কারণে প্রাণ আর প্রকৃতির সৃষ্টি আর প্রবাহ সেই প্রপঞ্চই তো মানুষের সবচেয়ে আরাধ্য হবে, সেই প্রপঞ্চই তো সকল পরম চিন্তার মুলে থাকবে এ আর বিচিত্র কী?