সখী দর্শন কারে কয়?

কেঁচেগণ্ডূষ বলে বাংলায় একটা শব্দ আছে যার অর্থ আবার নতুন করে শুরু করা। তাই দর্শনের পাঠ আবারো আমি নতুন করে শুরু করলাম। আসলে শুরু করতে বাধ্য হলাম। কারণ আমি রীতিমতো চমকে গেলাম একটা ঘোষণা শুনে যে, “দর্শন সঠিক-বেঠিক নির্ধারণ করে দেয়”। সেটা একজন বুদ্ধিজীবী সগৌরবে ঘোষণাও করছেন। তিনি লিখছেন।

“আমরা যখন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের দর্শনের অ-আ-ক-খ পাঠ দান করি, তখন ৫টি শাখার কথা বলি। সেগুলো হচ্ছেঃ মেটাফিজিক্স (অধিবিদ্যা), এপিষ্টেমোলজি (জ্ঞানতত্ত্ব), এথিকস (নীতিবিদ্যা), পলিটিক্স (রাজনীতি) ও এসথেটিক্স (নন্দতত্ত্ব)।  দর্শনের প্রতিটি শাখায় সঠিক-বেঠিকতা ধারণা ইনবিল্ট। কিন্তু এথিক্স বা নীতিবিজ্ঞান বলে যে শাখাটা আছে – যার আরেক নাম হচ্ছে মৌর‍্যাল ফিলোসফি – তার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে সঠিকতা ও বেঠিকতা নিয়ে। এথিক্স কী, তার সংজ্ঞায় বলা হয়ঃ “The field of ethics (or moral philosophy) involves systematizing, defending, and recommending concepts of right and wrong behavior.” অর্থাৎ, নীতিবিদ্যা বা ন্যায়দর্শনের ক্ষেত্রসমূহের কারবার হচ্ছে সঠিক ও ভ্রান্ত আচরণের সংজ্ঞায়ন, বিধিবিন্যাস ও সুপারিশকরণ।“

গুগোল করা জ্ঞানের আলোয় আমাদের আলোকিত করার জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন। তবে পাঠক হিসেবে তিনি আমাদের বঞ্চিত করেছেন গুগলের কোথায় থেকে তিনি টুকলিফাই করেছেন সেটা দেখিয়ে না দেয়ার জন্য। তিনি সংজ্ঞাটা নিয়েছেন এখান থেকে। আর দর্শনের পাঁচটি শাখার বিষয়টা নিয়েছেন তিনি এখান থেকে। আগ্রহী পাঠক আরো গুগোল করলে দেখতে পাবেন কোথাও কোথাও দর্শনের সাতটি শাখার উল্লেখ আছে। উনি দুটো শাখা বাদ দিলেন কেন সেটা অবশ্য আমি বুঝতে পারিনি। সব কিছুতেই নিশ্চয়তা এবং শেষ কথা খুজতে যাওয়া এই বুদ্ধিজীবী শেষ পর্যন্ত যখন দর্শনেও সঠিক বেঠিক খুঁজতে যান তখন দর্শনের একজন নগণ্য ছাত্র হিসেবে আমার কিছু বলার দায় তৈরি হয়ে যায়।

যাই হোক, বড় বড় কথা বলে পাঠককে ঘাবড়ে দেয়া একটা কৌশল হতেই পারে কিন্তু আমি উনার বক্তব্যের খণ্ডনের রাস্তায় যাবো না। আমি সহজভাবে দেখানোর চেষ্টা করবো দর্শন বিষয়টা কী? দর্শন কী নিয়ে ডিল করে এবং দার্শনিক ইনকোয়ারি কী? পাঠক নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কোন বক্তব্যটা গ্রহণ করা উচিত।

দর্শন মানুষের চিন্তার গণ্ডি বাড়ানোর নিরন্তর চেষ্টার নাম। দর্শন কোন বিজ্ঞান নয় যে সেটা ডেটা বা উপাত্ত সংগ্রহ করে কোন কিছু প্রমাণ বা অপ্রমাণ করবে। এটা কোন কলা বা আর্ট ও নয় যে তাঁর অনুভুত জগতকে সে তাঁর কল্পনা দিয়ে প্রকাশ করবে। দর্শন এমন একটি অনন্য পদ্ধতি যা বিজ্ঞান এবং কলার মধ্যবর্তী ধুসর এলাকা নিয়ে কাজ করে। দার্শনিক অনুসন্ধানের পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে যদি একটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে হয় তাহলে এটা বলা যায় যে এই সামগ্রিক অনুসন্ধানের বিষয়ে সাধারন কোন ঐক্যমত্য না থাকা। এর কারণ হচ্ছে দার্শনিকেরা যে সমস্ত বিষয় নিয়ে কাজ করেন সেটা এমন একটা ধুসর চিন্তার এলাকা যেখানে ঐক্যমত্য অসম্ভব। বিজ্ঞানে সাধারণভাবে ব্যাপক ঐক্যমত্য থাকে। কিন্তু বিজ্ঞান ও জ্ঞানের নানা এলাকা এমন কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয় যেগুলোর উত্তর ঐ বিষয়টির মধ্যে থেকে পাওয়া যায়না। দর্শন সেগুলো নিয়ে কাজ করে। যেমন ধরুন মানব ক্লোনিং এর বিষয়টা। বিজ্ঞান মানব ক্লোনিং জানে কিন্তু এই মানব ক্লোনিং এর চর্চা শুরু হবে কিনা সেটার বিতর্ক বা ফয়সালা বিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে হয়না; হয় দর্শনের পরিমণ্ডলে।

অ্যামেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়া দুই পরাশক্তি তৈরি হয়েছে দুই দার্শনিকের চিন্তার উপরে ভিত্তি করে। টম পাইন আর কার্ল মার্ক্স। এই দুইজনের চিন্তা তো বিপরীত মুখি চিন্তা। এই দুইজনের মধ্যে কে সঠিক? এর উত্তর কি দর্শন নির্ধারণ করেছে? এনলাইটেনার ভলতেয়ার সঠিক নাকি তাঁর ক্রিটিক পৌস্ট মর্ডানিস্টরা সঠিক? র‍্যাশনালিস্টরা সঠিক নাকি তাঁদের বিপরীতে দাঁড়ানো এম্পেরিসিস্টরা সঠিক? হেগেল সঠিক নাকি তাঁর ক্রিটিক মার্ক্স সঠিক?

পাঠক আপনার কী মনে হয়? দর্শনের কাজ কি সঠিক- বেঠিকতা নির্ধারণ? দর্শন পড়তে গেলে আপনি কি সঠিক বেঠিকতার বিষয় কোথাও খুজে পান? নাকি চিন্তার বিপরীতে অসংখ্য প্রশ্নের শৃঙ্খল পান? এই দুই প্রশ্নের উত্তরেই ফয়সালা লুকিয়ে আছে। এর উত্তরেই আপনি নিচের অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন সেটা নিশ্চিত।

দর্শনের কর্তব্য সত্য নির্ণয় নয়বরং নানান ভাষা বয়ানে চিন্তার ক্রমাগত পর্যালোচনা।

দর্শন সম্পর্কে এই প্রাথমিক ধারণাটুকু যার নেই তাঁর দর্শন ক্লাসের ছাত্রদের জন্য আসুন সমবেদনা জানাই।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter