রোহিঙ্গা, কাশ্মীর, জুম্মল্যাণ্ডঃ আপনি কোন লড়াইকে কীভাবে সমর্থন দেবেন? কেন দেবেন?

যখনই কোন কর্তৃত্ববাদী (Totalitarian বা dictatorial অর্থে) রাষ্ট্র তার দানবগিরির ফলে মানবিক বিপর্যয় তৈরি করে তখন সমাজে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। সমাজের বিতর্ক সমাজের স্বাস্থ্যের লক্ষণ হয়ত। তবে আমার মনে হয়েছে তরুণেরা এতে বিভ্রান্তও হয়। নিজের অবস্থানকে তারা ঠিক যুক্তি দিয়ে সাবসটেনশিয়েট করতে পারেনা। যখন কাশ্মীরের স্বাধীনতা চাই কেউ কেউ বলেন তখন বাংলাদেশেও তো জুম্মল্যাণ্ডেরও স্বাধীনতার কথা অনেকে মনে করায় দিতে চান, শোনা যায়। অথবা রোহিঙ্গারাও কি রাষ্ট্র গড়ুক সেটা চাই? এই প্রশ্নগুলোর কোন সহজ এবং একক উত্তর নাই। প্রত্যেকটা বিষয় আলাদা আলাদা করে বিবেচনা করতে হয়।

কাশ্মীর

কাশ্মীরের ভাগ্য কাশ্মীরিরা ঠিক করুক, সেই সুযোগ তারা পাচ্ছেনা। নানা ছুতায় তাদেরকে দমন করা হচ্ছে। ১৯৪৭ এর পর থেকে এ’পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্র থেকে যা যা প্রতিশ্রুতি তাদের দেয়া হয়েছিল তা ভঙ্গ করা হয়েছে। তাই তাদের লড়াই থেমে নাই। ভারত রাষ্ট্র তাদের কথা শোনেনি। বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পরে এটা আর স্পষ্ট হয়েছে কাশ্মীরে ভারতের কোন কর্তৃত্ব নাই। এই জনতাকে সে আর পাবেনা। শক্তি খাটিয়ে সে হয়তো কাশ্মীরিদের দাবিয়ে রাখতে পারবে, কিন্তু কাশ্মীরিরা ভারতের কর্তৃত্ব যেভাবে সম্ভব অস্বীকার করবে। আমরা চাই কাশ্মীরে যেন মানবাধিকার লংঘিত না হয়। কাশ্মীর স্বাধীন হবে কিনা হতে চায় কিনা হলে ওর ভাল-মন্দ তারা নিজেরাই ঠিক করুক। তবে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিবার সুযোগ তাদের অবারিত হতে হবে। কাশ্মীরের স্বাধীনতা হয়ত অসম্ভব নয়। তারা পাল্টা ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম। তবে স্বাধীন হলে পরে সম্ভব্য সে পরিস্থতিতে পড়শি কারা থাকবে সে ম্যাপ, সিনারিও আকা খুব সহজ কাজ নয়। বহু হিসাব কিতাব আছে সেখানে। ফলে এর সিদ্ধান্ত কাশ্মীরিরা নিজেদেরই নিবার সুযোগ থাকতে হবে। ওদিকে কাশ্মীরিদের লড়াইকে ভারত পাকিস্তানের উস্কানি বলে বিশ্ববাসীকে দেখায়। যেন ভারতের দখলি অংশের কাস্মীরীরা – ওদের কোন চাওয়া পাওয়া নাই, ভারতের কোন দমন নির্যাতন হত্যা নাই। এই কাশ্মরীরা একেকজন কাঠপুতুল পাকিস্তানের ইচ্ছাতেই যারা কেবল নাচে। ফলে সবই পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র। ঠিক যেমন ১৯৭১ সালে আমাদের সম্পর্কে পাকিস্তানের শাসকেরা প্রচার করত যে সব ভারতের ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষদের কোন চাওয়া পাওয়া নাই। তাহলে আমরা কী করবো? আমরা প্রথমত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বলবো। এটায় আমাদের কোন সমাজের যে কোন অংশের পক্ষেরই কোন অসুবিধা নাই। সে বাম হোক ডান হোক, ইসলামি অথবা মধ্যপন্থী হোক। আপনি কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবীকে সমর্থন করেন না করেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে বলুন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলুন আর তাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের অবারিত সিদ্ধান্ত নিবার সুযোগ দাবি করতে পারেন। অসুবিধা কী? ভারত রাষ্ট্রের বাণী আপনি ঝাড়বেন কেন?

 

রোহিঙ্গা আর আরাকান রাষ্ট্রের সম্ভাবনা

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মাত্র ১১-১৪ লাখ। ফলে আলাদা রাষ্ট্র পাল্টা ক্ষমতা গড়ার জন্য এটা যথেষ্ট সংখ্যা কিনা তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন। তবে আলাদা আরাকান রাষ্ট্রের বিষয়ের চেয়ে তারা যেন নিজ ভিটামাটিতে টিকে থাকতে পারে রিফুইজি না হতে হয় , হত্যা নির্যাতনের শিকার না হয় এটাই এখনকার জলন্ত ইস্যু। তাহলে এখন করণীয় কী আমাদের। এখানে হিউম্যান রাই্যট ইস্যু নিয়ে কথা বলা; সোচ্চার হওয়া; আশ্রয় চাইলে পাওয়া এগুলোই প্রধান বিষয়। এর জন্য দরকার ডকুমেন্টেশন, রিপোর্ট, লবিং, আন্তর্জাতিক সংস্থার নজর এবং ভিক্টিম হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন। এখানে দেখেন কাশ্মীরের সাথে বেইসিক একটা তফাত হচ্ছে কাশ্মীররা অন্তত জমায়েত হয়ে প্রতিবাদ করতে পারে এবং সেটা কার্ফু ভেঙ্গে হলেও। এটা ভারতের শাসকদের কোন বিশেষ ক্রেডিটের জন্য না। সামগ্রিকভাবে ভারতের রাজনৈতিক কালচার, নির্বাচিত সরকার, একটা ফাংশনাল রিপাবলিক থাকার পরোক্ষ সুবিধা কাশ্মীরীরা পায় সেজন্য। বিপরীতে বার্মা বৃটিশরা ছেড়ে যাবার পর থেকে এটা কোন নুন্যতম নির্বাচিত কোন সরকারের রাষ্ট্রই হতে পারেনাই। রোহিঙ্গারা দূরে থাক স্থানীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠিরাই কোন মানবিক রাজনৈতিক অধিকার নাই। রোহিঙ্গাদের লড়াইটা কাশ্মীরের চাইতে অনেক জটিল এবং সমস্যাসংকুল

 

পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অসন্তোষ

পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যা অসন্তোষ আছে সেটার সমাধান খুবই সম্ভব। বাস্তব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমাধান সম্ভব; যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চায় তাহলে সম্ভব। বাংলাদেশকে বাঙালির রাষ্ট্র বানাতে চাওয়া আর তাদের উপর সেই বাঙালিয়ানা চাপায় দিতে চাওয়াটা শতভাগ অন্যায়, অগ্রহনযোগ্য। । অসন্তোষের একটা বড় শুরু তো সেখানে থেকেই। তাহলে সমাধান কোন পথে। আমরা একসাথে বসে যেই ভবিষ্যতের রিপাবলিক বানাবো সেই রিপাবলিকে সম নাগরিক অধিকার নিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থাকবে। তবে তাদের ভুমির সমস্যা প্রসঙ্গে অবশ্যই পাহাড়িরা আগে যে যেই ভুমিতে বসবাস চাষাবাদ করত তাকে ঠিক সেখানে বসাতেই হবে এই সলিড ভিত্তিতে সমাধান অবশ্যই সহজে খুঁজে নিতে পারি। সেজন্য তো ডায়ালগ করতে হবে, সমতলের রাজনৈতিক শক্তির সাথে ভাব দেয়ানেয়া করতে হবে। সেটা না করে শুধু দাবী করলে তো চলবেনা যে একমাত্র তাঁদের বাতলানো পথেই সমাধান করে দিতে হবে। বাস্তবে সেটা হবেও না।

পাহাড়ে বাঙালি ঢুকতে পারবেনা, এটা নেগেটিভ আবদার। আত্মঘাতি। তবে শুনতে মনভোলানি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠি মোট ১২-১৫ লাখ। কেবল নিজেরাই পণ্য বানাবো আর সেই পণ্য নিজেরাই কিনব – এমন বুদ্ধির ইকোনমি একটা আলাদা রাষ্ট্র বানায়ে এই জনসংখ্যায় টিকানো অসম্ভব। এরচেয়ে পাহাড়ি-সমতলি পণ্য বিনিময়ের একটা অর্থনীতিতে ১৫ লাখ পাহাড়িরা পেতে পারে ১৬ কোটির ভোক্তা বাজার। যে কোন পাহাড়ি পণ্যের ক্ষেত্রে একথা সত্য।

তবে এটা ঠিক যে পাহাড়িদের প্রেফারেন্স বা প্রায়োরিটি নিশ্চিত করার একটা দিক আছে যেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি চাইলে নিউ ইয়র্কে বাড়ি কিনতে পারি, আর পার্বত্য চট্টগ্রামে কিনতে পারবোনা জমি, এটা এই গ্লোবাল বিনিময়ের যুগে এবসার্ড। তবে অবশ্যই আপনারা বলতে পারেন, আপনাদের এলাকায় খোদ আপনারাই যেন মারজিনালাইড না হন। নির্ধারক সাংস্কৃতিক আধিপত্য যেন কমে না যায়; সংস্কৃতি যেন রক্ষা পায়, বৈষ্যমের শিকার যেন না হন, ঠিক আছে এসব বলুন। উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তির সাথে নিগোশিয়েশন করেন। কিন্তু চান্স পাইলেই অস্ত্র হাতে আমার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন এইটা একই সাথে চলবেনা। এই রাষ্ট্র আপনারও এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন এক রিপাবলিক করে গড়ে নিতে চাইলে সমতলিদের বেশির ভাগকেই সাথে পাবেন। ।

পরিশেষে

উপরে তিনটা সিনারিও তে কথা বলেছি। কিন্তু কমন দিক হিসাবে নীতিগত একটা বলে রাখা ভাল। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, নিজেই নিজেকে শাসন-পরিচালনের অধিকার এমনকি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অধিকার সবার আছে থাকতে হবে – নীতিগতভাবে এটা মেনেই উপরের কথাগুলো বলেছি।

তবে মনে রাখতে হবে যে – এটা জরুরি না যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াই সব সমস্যার একমাত্র সমাধান। একথা সত্যিও নয়। তবে সকলের সম-মর্যাদা নিশ্চিত করা, নীতিগতভাবে এবং ব্যবহারিক ও কার্যকরভাবে তা ফুটিয়ে তোলা এই সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য নির্ধারক। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা বা ডায়লগ ও আগানো যেন শুরু হয়– এটাই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। ফলে গঠনমূলক ও ইতিবাচকভাবে কথা বলা, পরস্পর “অপর” এর প্রতি কোন বর্ণবাদী আচরণ আক্রমণ এড়িয়ে আমাদের এই আলোচনায় অংশ নিতে হবে।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter