রাই আমাদের রাই আমাদের, আমরা রাইয়ের, শ্যাম তোমাদের, রাই আমাদের

লোপামুদ্রা মিত্রের কণ্ঠে একটা অপূর্ব কীর্তন আছে। পুরো কীর্তনটা এই রকম।

বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের ()

রাই আমাদের রাই আমাদের, আমরা রাইয়ের, শ্যাম তোমাদের, রাই আমাদের ()

বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের ()

 

শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদন মোহন।

আহা শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদন মোহন।

আর সারী বলে, ()

আমার রাধা বামে যতক্ষন নইলে শুধুই মদন।

বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের। ()

 

শুক বলে আমার কৃষ্ণের চুড়া বামে হেলে।

আহা শুক বলে আমার কৃষ্ণের চুড়া বামে হেলে।

আর সারী বলে,

আমার রাধার চরন পাবে বলে, চুড়া তাইতো হেলে।

বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের। ()

 

শুক বলে আমার কৃষ্ণের মাথায় শিখির পাখা।

আহা শুক বলে আমার কৃষ্ণের মাথায় শিখির পাখা।

আর সারী বলে, ()

আমার রাধার নামটি তাতে লেখা, সে যে যায়না দেখা।

বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের। ()

 

শুক সারী দুজনার দ্বন্দ্ব ঘুচে গেল।

আহা শুক সারী দুজনার দ্বন্দ্ব ঘুচে গেল।

রাধা কৃষ্ণের নামে এবার হরি হরি বলো,

বৃন্দাবনে চলো।

 

শুক আর সারীর তর্কের মেটাফরে এক অসামান্য দার্শনিক প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে দুর্ধর্ষ মুন্সিয়ানায়। যেই দার্শনিক তর্কের উত্তর পেতে ইউরোপকে মার্ক্সের আবির্ভাব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

শুক হচ্ছে ভাব রুপী চৈতন্যের প্রতিনিধি আর সারী হচ্ছে বস্তু জগতের প্রতিনিধি। এই দুজন তর্ক করছে কে শ্রেষ্ঠ? প্রকৃতি রুপী রাধা নাকি চৈতন্যরূপী কৃষ্ণ?

বাঙলার ভাব দর্শনে কৃষ্ণ ভগবান মানে পুরুষ আর রাধা প্রকৃতি। রাধা আর কৃষ্ণও মেটাফর। সাংখ্য দর্শনে অনুসারে “পুরুষ” হচ্ছে কৃষ্ণ আর “প্রকৃতি” হচ্ছে রাধা। পুরুষ হচ্ছে চৈতন্য বা চেতনা আর প্রকৃতি হচ্ছে বস্তু বা বিশ্ব প্রকৃতি। দ্রষ্টার কাছে পুরুষ যখন কর্তা সত্তা হিসেবে আবির্ভূত হন তখন প্রকৃতি হয়ে যায় তাঁর অধীন। এই পুরুষ আর প্রকৃতির সম্পর্ক সপ্রান এবং দান্দ্বিক। আমরা সবাই রাধা। তাই শ্রী চৈতন্য অন্তরে কৃষ্ণকে নিয়ে বহিরঙ্গে রাধা হয়ে কৃষ্ণের সাথে মিলনের জন্য সাধনা করেছেন। বাঙলায় কৃষ্ণ রাধার সাথে মিলিত হয়ে চায়। কৃষ্ণ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে প্রান্তে চলে আসেন সৃষ্টির সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। দেরিদার ভাষায় স্রষ্টার অবিনির্মান ডিকনস্ট্রাকশন ঘটে। উপেক্ষিত প্রকৃতি রাধার প্রতিমূর্তি হয়ে স্রষ্টার সাথে প্রেমময় মিলনে মুক্তি পায়। ভাব আর বস্তুর একাকার হয়ে যায়।

শুক যখন বলে আমার কৃষ্ণ মদন মোহন। সারী তখন বলে রাধা আছে জন্যই সে “মদনমোহন” নইলে কৃষ্ণ কে? রাধা ছাড়া একা সে তো শুধুই “মদন”। বাক্য গঠন ও শব্দ চয়ন লক্ষ্য করুন। কি দুর্ধর্ষ মুন্সিয়ানায় ভগবান রুপী কৃষ্ণকে “মদন” বলা হল।

ইউরোপের দর্শনে পুরুষ নাকি প্রকৃতি কর্তা এটাই ছিল দর্শনের জগতের এক মুল প্রশ্ন। আমরা যেটাকে ভাববাদ আর বস্তুবাদের ঐতিহাসিক ঝগড়া বলে জানি।

এই দ্বন্দ্ব বাঙলা কীভাবে ফয়সালা করলো? কীর্তনের শেষ অংশটা দেখুন। বাঙলা বলছে “রাধা কৃষ্ণের নামে এবার হরি হরি বলো”। রাধা আর কৃষ্ণ আলাদা নয় একসাথেই দুজনে মিলেই “হরি” মানে সেই পরম। ভাব বস্তুতে বিলীন হয়, সেই সত্য। এককভাবে কেউ সত্য নয় এই যুগল উপস্থিতিই সত্য।

এবার কীর্তনটা শুনুন এখানে। নতুন আলোয় ধরা দেবে এই গান আরেকবার।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter