“যে জন প্রেমের ভাব জানে না” গানটির অর্থ কী?

এই গানটি আমরা সবাই শুনেছি, একটা প্রেমের গান হিসেবে। পুরো গানটি আরেকবার দেখুন।

যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা, সে জন সোনা চেনে না ।।

কুটা কাঁটায় মানিক পাইল রে, অথই পানিতে ফেলিয়া দিল রে সাত রাজার ধন মানিক হারাইয়া ( হায়রে) কুটাকাঁটায় মন যে মানে না, সে জন মানিক চেনে না।।

উল্লুকের থাকিতে রে নয়ন, না দেখে সে রবির কিরণ কি কব দুস্কের কথা ( আমি) সে জন ভাব জানে না, সে জন মানিক চেনে না।।

পিঁপড়া বোঝে চিনির দাম, বানিয়ায় চিনে সোনা মাটির প্রেমের মূল্য কে জানে ( হায়রে) ধরায় আছে কয়জনা, সে জন মানিক চেনে না।।

এই গানটি মোটেই মানব মানবীর প্রেমের গান নয়। আমি এখানে শুধু প্রথম চার লাইনের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো, বিশেষ করেপ্রেমের ভাব এই শব্দ দুটির। ভাব শব্দটি বাঙলায় প্রথম যে অর্থটি প্রকাশ করে সেটা “চিন্তা” বা “ভাবনা” নয়। “ভাব” শব্দটির ব্যঞ্জনা না বুঝলে “প্রেমের ভাব” শব্দ যুগলের ব্যাখ্যা অসম্ভব। ভাব শব্দটি এসেছে “ভু” থেকে। সংস্কৃত “ভু” শব্দ থেকে এসেছে “বাঙলায় “ভাব” শব্দটি। “ভূ” মানে “হয়ে ওঠা”, যেমন “স্বয়ংভু” যার মানে “নিজে থেকেই তৈরি”। সেই অর্থে “ভাব” অর্থ মানে শুধু চিন্তা নয়, “ভাব” মানে হয়ে ওঠাও। কী হয়ে ওঠা? যা মানুষ হতে চায় কিন্তু পারেনি এখনো, সেই “না হওয়ার” হয়ে ওঠা। বাঙলায় “ভাব” মানে চিন্তা আর চর্চার মধ্যে দিয়ে “হয়ে ওঠা”।

তাহলে “প্রেমের ভাব” মানে “প্রেম যা “হয়ে উঠতে চায়”। প্রেম কী হয়ে উঠতে চায়? এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্য আমরা লুদভিগ ফয়েরবাখের সাহায্য নেব। ফয়েরবাখ এসেন্স অব ক্রিস্টানিটিতে মানুষের মৌলিক প্রেষণার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন “ধর্ম হচ্ছে মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের বিচ্ছেদ; সে তার নিজের বিপরীতে ঈশ্বরকে বসায়। মানুষ যা ঈশ্বর তা নন, আর ঈশ্বর যা মানুষ সেটাও নয়। ঈশ্বর অসীম, মানুষ সসীম; ঈশ্বরের কোন খুঁত নাই, কিন্তু মানুষের খুঁত আছে; ঈশ্বর কালাতীত কিন্তু মানুষ কালের অধীন; ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, মানুষ দুর্বল; ঈশ্বর পবিত্র, মানুষ পাপী। ঈশ্বর আর মানুষে চরম ফারাক: ঈশ্বর একদমই যথার্থ, সকল ইহলৌকিক বাস্তবতার যোগফল; মানুষ একদমই নিরর্থক, নিজের অর্থহীনতা নিয়েই তার চিন্তা। কিন্তু ধর্মে মানুষ তার সুপ্ত স্বভাবেরই ধ্যান করে”।

ফয়েরবাখ বলছেন, মানুষ নিজের দিব্যস্বভাব থেকে বিযুক্ত হয়ে যায়, এটা জন্মগত। অন্যদিকে নিজের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া সেই দিব্যসত্তার সঙ্গে একীভূত হবার আকাঙ্ক্ষাই মানুষের “হয়ে ওঠার” লড়াই। মানুষ দিব্য সত্তার সাথে অভেদ অনুভব করবে সেটাই মানুষের “হয়ে ওঠার” শেষ বিন্দু।

সেই দিব্য সত্তার সাথে যুক্ত হওয়ার পথ কী? ফয়েরবাখ বলেছিলেন, “এই চরিত্র আর কিছুই নয় মানুষের বুদ্ধি, মানুষের যুক্তি, যাতে মানুষ বুঝতে পারে আল্লাহ হচ্ছেন মানুষের এন্টিথিসিস মাত্র যিনি মানুষ নন; অর্থাৎ যিনি নিজে মানুষ নন, কিন্তু বুদ্ধিরই নৈর্ব্যক্তিক রূপ। বিশুদ্ধ, নিখুঁত দিব্য স্বভাব হচ্ছে বুদ্ধিরই আত্মসচেতনতা, সেই চৈতন্য যার দ্বারা বুদ্ধি নিজের খুঁত (perfection) সম্পর্কে ধারণা করতে পারে”

তাঁর মানে ফয়েরবাখ বলছে, বুদ্ধির জগতে মানুষ দিব্য স্বভাবের সাথে যুক্ত হয়। এটাই ইউরোপের চিন্তা। বাঙলা মনে করে দিব্য সত্তার সাথে প্রেমের মাধ্যমে যুক্ত হয়। তাহলে প্রেম হচ্ছে সেই “হয়ে ওঠার” পথ। “প্রেমের ভাব” মানে প্রেম কী হয়ে উঠতে চায়।

যে প্রেমের এই ভাব জানেনা, তাঁর সাথে তো কোন লেনাদেনা বা আলাপ আলোচনাই হতে পারেনা। সে তো আসল সোনাই চেনে না। খাটি সোনা সেই দিব্য সত্তা যার সাথে প্রেমের মাধ্যমে যুক্ত হওয়াই মোক্ষ।

এবার গানটি শুনুন, মজা পাবেনঃ

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter