রাজ্য, দেশ, সাম্রাজ্য, গোত্র আর রাষ্ট্র এক জিনিস নয়। রাষ্ট্র বিশেষভাবে নির্মিত একটি পলিটিক্যাল সংগঠন। রাষ্ট্র বা স্টেইট সবসময় সার্বভৌম নাও হতে পারে। রাষ্ট্র বা স্টেইট শব্দটা ১৬ শতকের ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স প্রকাশিত হওয়ার আগে অজানা ছিল। পুজিবাদের উদ্ভব আর রাষ্ট্র নামের রাজনৈতিক প্রপঞ্চের যাত্রা একই সময়ে। এর আগে আমরা আধুনিক রাষ্ট্র বলতে যা বুঝি তা ছিলনা। রাষ্ট্র নামের কোন ধারণাও ছিলনা। থাকা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের প্রয়োজন কেন হল তাহলে? দেশ, সাম্রাজ্য বা রাজ্য থাকলে কী সমস্যা ছিল? সমস্যা ছিল একটা বিরাট। পুঁজিবাদ শুধু একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়, সে একটা জীবন বিধানও বটে। পুঁজিবাদ আসার সাথে সাথে সে আধুনিকতা বা মডার্নিজমকে সাথে করে নিয়ে আসে। এই মডার্নিজমের অনিবার্য অনুষঙ্গ “ব্যক্তি” বা ইন্ডিভিজুয়াল। প্রশ্ন উঠতে পারে এর আগে কি ব্যক্তি ছিলনা? হ্যা ছিল কিন্তু ব্যক্তিবাদ ছিলনা, যেই ব্যক্তি ছিল সে সমাজের অধীন ছিল। ব্যক্তির স্বাধীন স্বীকৃত অস্তিত্ব ছিলনা। একটা উদাহরণ দেয়া যাক, কৃষি কর দেয়া হতো গ্রাম ভিত্তিক। মানে একটা গ্রামের সবাই একসাথে রাজাকে কর দিত। আলাদা করে ব্যক্তি কর দিতনা। রাজ্যের সম্পর্ক ছিল কমিউনিটির সাথে। পুত্র অপরাধ করলে আমরা বাবাকে ধরতাম তার পরিবারকে ধরতাম, বলতাম, এই বাড়ির ছেলে হয়ে তুই এই আকাম করলি কীভাবে? অথবা বলতাম, তুই না এই গ্রামের ছেলে?! লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যেত। এখন আপনি আর এইটা পারবেন না, পুত্রের অপরাধের দায় পিতার নয়, গ্রামের মানুষের নয়। পুত্র বা গ্রামের ছেলে ব্যক্তি হিসেবে তার দায় নেয়। ব্যক্তিই শাস্তি পাবে, সমাজ নয়। সমাজের কারো মাথা কাটা যাওয়ার ভয় নাই।
সমাজের এই অধীন মানুষকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কারণে লোভী আর স্বার্থপর বানানো কঠিন। লোভী আর স্বার্থপর মানুষ ছাড়া পুঁজিবাদ অচল। মুরুব্বীকে দেখে সিগারেট লুকালে সিগারেট কোম্পানির ব্যাবসা হবে কীভাবে? তাই সে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের উর্ধে ব্যক্তি নামের এই ধারণা তৈরি করে। সেখানে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাই সর্বোচ্চ।
তাহলে এই ব্যক্তিকে তো একটা রাজ্য তার পুরোনো কাঠামো দিয়ে ধারণ করতে পারেনা। তার সাথে আলাদা চুক্তি দরকার। এই চুক্তিই রাষ্ট্র। রাজ্য আর রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক মিল থাকতে পারে, কিন্তু মুল যেই অমিল সেইটা হচ্ছে “ব্যক্তি” নামের প্রপঞ্চ থাকা আর না থাকা।
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন