যুক্তিহীনতার অ্যানাটমিঃ আবেগের কাছে যুক্তি কেন পরাজিত হয়?

আমরা সকলেই জানি,  সিগারেট ক্ষতিকর, সিগারেট অনেকগুলো প্রাণঘাতী রোগ তৈরি করে। ধূমপান ছেড়ে দিলে সেই রোগগুলো থেকে দূরে থাকা যায়। এটা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণিত এবং এই সত্য নিয়ে আমাদের যুক্তিবাদী মনে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ধূমপায়ীরা কি এই সত্য গ্রহণ করার পরেও ধূমপান ছাড়তে পারে? বেশীর ভাগই পারেনা। আবেগের কাছে যুক্তির এই পরাজয়ের ব্যাখ্যা কী? কেন এমন হয়? এটাকে কি শুধু “কমফোর্ট জোনের” তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? আবার কমফোর্ট জোনের তত্ত্বটাও এই জটিল ডিসকোর্সের ব্যাখ্যায় অনুসন্ধানী মনকে তৃপ্ত করতে পারেনা। এই জটিল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে মানুষের মস্তিষ্কের গঠন এবং তার আদি প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার বিভিন্ন কালপর্বের ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্যে।

ফুলকপির সাথে সাদৃশ্য

মানুষের মগজটা দেখতে অনেকটা ফুলকপির মতো। ফুলকপির যেমন একটা মুল থাকে এবং সেটা থেকে নানা কাণ্ড দিয়ে ফুলে ফুলকপির আকার ধারণ করে, তেমনি মানুষের মগজ দেখলেও মনে হবে একটা কাণ্ড দিয়ে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ফুলিয়ে মগজটাকে বড় করা হয়েছে।

মগজটা কি ঠিক এমনই নয়?

কোটি কোটি বছর আগে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিলো সমুদ্রে। সেই সমুদ্রের কিছু প্রাণী যখন উভচর হবার বাসনায় ডাঙ্গায় উঠে এসেছিল তাদের ছিল সরীসৃপের মগজ। সেই মগজের কোন চিন্তাশীল অংশ ছিল না, তার কাজ ছিল খুব জরুরী প্রান ধারণের তথ্য সংশ্লেষ করা, যেমন, ক্ষুধা লেগেছে কিনা, ঘুম দরকার কিনা, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা বা গরম লাগছে কিনা, কোন বিপদ আসছে কিনা ইত্যাদি। মগজের জন্য এসব খুব প্রিমিটিভ বেসিক ফাংশন। এই সরীসৃপের মগজে আবেগ, ইমশোন বা ভালবাসা নেই। এসব অনুভব করার মতো গঠন ও নেই। এই সরীসৃপের মগজ আমাদের মগজে এখনো আছে মগজের সবচেয়ে ভিতরের অংশ হয়ে আর সেই একই আদি অকৃত্রিম কাজ করে চলেছে। এর পোশাকি নাম রেপ্টাইল ব্রেন।


একদম ভিতরের অংশ দেখুন, রেপ্টাইল ব্রেন

এর পরবর্তী স্তরে মগজ আরো বিকশিত হয়ে হোল স্তন্যপায়ীর মগজ। এই স্তন্যপায়ীর মগজটা তৈরি হোল সরীসৃপের মগজের উপরে একটা মোটা প্রলেপর মতো। ঠিক যেন রেপ্টাইল ব্রেন বাইরের দিকে ফুলে এই নতুন ব্রেনটা তৈরি হোল। মগজের এই নতুন অংশের নাম ইমোশোনাল ব্রেন, পোশাকি নাম লিম্বিক সিস্টেম আর কাজ হচ্ছে আবেগ, ভালবাসা, ইমশোন, স্নেহ এসব সূক্ষ্ম অনুভুতির সংশ্লেষ। এজন্যই দেখবেন আমরা বিড়াল, কুকুর, গরু, ঘোড়া এসব স্তন্যপায়ীকে পোষ মানাতে পারি, ওদের আনুগত্য পাই, ওরা আমাদের ভালবাসা বোঝে প্রতিদানও দেয় কিন্তু সাপ পোষ মানানো যায় না, সাপ ভালবাসাও বোঝে না। আমাদের মগজের মাঝের অংশটা ইমোশোন্যাল ব্রেন।

আমাদের মগজ এবং কোন অংশ থেকে কোন অনুভুতির নিয়ন্ত্রণ হয়।

সবশেষে তৈরি হোল আমাদের নিও কর্টেক্স যেটা শুধু মানুষ আর সমগোত্রীয় প্রাণীর আছে। এই নিও কর্টেক্সও যেন ইমশোন্যাল ব্রেন বাইরের দিকে ফুলে তৈরি হোল। এই নিও কর্টেক্স আমাদের থিঙ্কিং ব্রেন বা চিন্তাশীল অংশ। এই চিন্তাশীল অংশ কোটি কোটি বছর ধরে বড় হচ্ছে। তাই আজকের মানুষের মগজ এনং তার চিন্তার ক্ষমতা তার পূর্বপুরুষের চাইতে বেশী, কারণ আজকের থিঙ্কিং ব্রেনের পরিমান আমাদের পূর্বপুরুষের চাইতে বড়।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের মগজের আকারের বিবর্তন

আমাদের রেপ্টাইল ব্রেন আমরা সচেতন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা, লিম্বিক ব্রেন আংশিক ভাবে করতে পারি আর নিও কর্টেক্স পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আবার, যেহেতু মগজটা তৈরিই হয়েছে বাইরের দিকে ফুলে ফুলে মানে রেপ্টাইল এবং লিম্বিক ব্রেন ফুলেই নিও কর্টেক্স তৈরি হয়েছে সেকারণে রেপ্টাইল এবং লিম্বিক ব্রেন থেকে নিও কর্টেক্সে একমুখী স্নায়ুর সংযোগ অনেক বেশী। কিন্তু উল্টো দিকে নিও কর্টেক্স থেকে রেপ্টাইল ব্রেন এবং লিম্বিক ব্রেনে একমুখী স্নায়ু সংযোগ সামান্য।

আমাদের পরিনত ব্রেন এবং রেপ্টাইল, ইমোশোন্যাল আর থিঙ্কিং ব্রেনের অবস্থান

আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে প্রত্যেক সেকেন্ডে আমাদের প্রিমিটিভ ব্রেন থেকে ৬ বিলিয়ন নার্ভ সেল ইম্পালস ফায়ার করে আর থিঙ্কিং ব্রেন করে মাত্র ১০০ টা। একারনেই আমাদের প্রিমিটিভ ব্রেন অনেক বেশী শক্তিশালী। তুলনামুলক দুর্বল সংযোগের কারণে আমাদের থিঙ্কিং ব্রেনের ইম্পালস আমাদের রেপ্টাইল ব্রেন এবং ইমোশোন্যাল ব্রেনের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। থিঙ্কিং ব্রেনের সাথে মোকাবেলায় আমাদের ইমোশোন এবং কনসার্ন ফর সেফটি সিকিউরিটি জয়ী হয়।

আমাদের রাজনীতিবিদরা এই বিজ্ঞানকে খুব কাজে লাগায়। আমরা প্রায়ই শুনি, জাতীয় নিরাপত্তার হুজুগ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের শ্লোগান, এসব আমাদের রেপ্টাইল ব্রেন কাছে আবেদন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আর সমাজতন্ত্রের আন্দোলন ইমোশোন্যাল ব্রেনের কাছে আবেদন। আর মুক্তমনাদের কথা থিঙ্কিং ব্রেনের কাছে আবেদন। মুক্তমনাদের আবেদন থিঙ্কিং ব্রেন গ্রহণ করার আগেই রেপ্টাইল আর ইমোশোন্যাল ব্রেনের কাছে পরাজিত হয়ে যায়। এভাবেই ইমোশোনের কাছে যুক্তি পরাজিত হয়ে যায়, কিন্তু এটাই মানুষের নিশ্চিত নিয়তি নয়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter