মানবতাবাদ : একটা জনপ্রিয় কিন্তু ভুল বুঝা ধারণা

মানবতা, মানবতাবাদ বা মানবতাবাদী এই শব্দগুলো আমাদের চিন্তার জগতে শিহরণ তোলে। আমাদের নিজেদের মানবতাবাদী বলে পরিচয় দিতে শ্লাঘা বোধ হয়। মানবতা এবং মানবতাবাদী শব্দদুটো আসলে কী বুঝায়? ইংরেজিতে এই শব্দটা হিউম্যানিটি। হিউম্যানিটি দিয়ে অবশ্য মানবজাতি ও মানবজীবন সম্পর্কিত চর্চা ও চিন্তাকে বুঝায়; অর্থাৎ মানবজাতির ইহজীবন, মনন, নৈতিকতা সম্পর্কিত চিন্তাধারা ও মানুষের মৌলিক গুণ বৈশিষ্ট্য বুঝাতে ব্যবহৃত হয়।

হিউম্যানিটি বা মানবতাবাদ হল মানুষ বিষয়ে এক ধরণের মতাদর্শ যা ডিভাইনিটির বিপরীতে মানুষই সব এবং সবার চাইতে গুরুত্বপুর্ণ এমন ধারণা প্রচার করে।

ওয়েবষ্টার ডিকশনারি বলছে হিউম্যানিজমের সহজ সংজ্ঞা হল, — a system of values and beliefs that is based on the idea that people are basically good and that problems can be solved using reason instead of religion। এটা হিউম্যানিটি নিজের সম্পর্কে কী মনে করে সে হিসাবে সংজ্ঞা হয়ত ঠিক আছে। কিন্তু ধর্মতত্ব আদৌ রিজন দিয়ে বুঝা যাবে কীনা, উপযুক্ত কীনা, যথেষ্ট কীনা – নাকি আরও কিছু লাগবে সেসব চিন্তার পদ্ধতিগত প্রশ্ন। বলা বাহুল্য হিউম্যানিটি ধারণার উদ্ভবের যুগে চিন্তার পদ্ধতিগত সেই প্রশ্নটা যথেষ্ট আলোকিত ও পরিস্কার ছিল না। এককথায় বলা যায়; চিন্তা পদ্ধতি হিসাবে ধর্মতত্বকে বুঝবার মত শানিত চিন্তা পদ্ধতি রিজন বা র‍্যাশনালিটির নয়।

বাঙলা ভাষায় মানবতাবাদ এই শব্দের উদ্ভব খুব বেশী দিনের নয়। একশো বছরেরও কম সময়। ১৩২৩ বাঙলা সালে প্রকাশিত জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে এই শব্দটা নেই। এটা বাঙলা ভাষায় ঢুকেছে ১৩২৩ সালের পরে সেটা নিশ্চিত।

মানবতাবাদ বা হিউম্যানিটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হলেও প্রধানত গ্রীক প্রবচন “মানুষই সব কিছুর মাপকাঠি” এই নিরিখে ডিভাইনিটি বা ঐশী সত্তার বিপরীতে ব্যক্তি মানুষকেই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু, আধার, শক্তি ও মুল্যবোধের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে। মানবতাবাদের এই পুরো ধারণাই এসেছে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতকে ইউরোপিয় রেঁনেসা যুগের সাথে হাত ধরে। মানবকেন্দ্রিক ও ইহজাগতিক এই শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি ছিল প্রাচীন গ্রীকো রোমান সংস্কৃতিতে আর তা দিয়েই এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলনে অনুপ্রানিত হয়।

এপর্যন্ত শুনে মনে হতে পারে, বাহ ভালোই তো। ব্যক্তি মানুষই তো সব। জ্বি না ভাইজান! এখানে মানুষকে স্পিরিরিচুয়াল বিইং বা পরম সত্তার চাইতে শক্তিমান বলে অনুমান করা হয়েছে। শুধু তাই না মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। “ব্যক্তি মানুষ” বলে কোন কিছুর অস্ত্বিত্ত থাকতে পারেনা। মানুষ সামজিক এনটিটি। মানুষ মাত্রই সামাজিক মানুষ, আজ কেবল সামাজিকভাবে (ব্যক্তিভাবে নয়) সে বিরাজমান। এটা মার্ক্সেরও কথা। অতএব মানবতাবাদ শব্দটা শুধু ধর্ম বা ধর্মতত্বই নয়, এর উদ্ভরের পরবর্তিকালে কার্ল মার্কসের ধারণারও বিরোধী। বা বলা যায় মানবতাবাদ ধারণাকে নাকচ করেই কার্ল মার্কসের জন্ম। মানবতাবাদের ধারণা শুধু ধর্ম নয়, সামাজিক মানুষ হিসেবে মার্ক্সের এই ধারণাকেও চ্যালেইঞ্জ করে।

মজার কথা হল আমরা যত্রতত্র যাকে তাকে “মানবতাবাদী” বলে গুণ আরোপ করি। ভাবি খুবই সম্মান করলাম। অথচ উলটা। যেমন অনেক কমিউনিষ্টকে কার্ল মার্কস সম্পর্কে বলতে বললে বলে বসবেন – উনি ত ‘মানবতাবাদী’ ছিলেন। কার্ল মার্কস আর যাই হোক তিনি কোন হিউম্যানিস্ট নন। অথবা ইসলামের নবী সম্পর্কে বলবেন নবী তো মানবতাবাদী। (যারা ধর্মতাত্বিক ভাবে এই বাক্য পাঠ করবেন তারা নাউজুবিল্লাহ পড়ে নিবেন।) অথচ মানবতাবাদ ধারণায় সব প্রশংসা এবং কৃতিত্ব নাকি মানুষের। কেবল মানুষের বন্দনা। এবং ব্যক্তি মানুষের। সম্ভবত মানুষের জন্য আর এক মানুষের পরান কাঁদে – এই হিউম্যানিটি ধারণা থেকে তারা যাকে তাকে মানবতাবাদী বানায় ফেলান।

তবে “আর এক মানুষের পরান কাঁদে” এই ধারণাটাও মূলত ধর্মতত্ত্বীয়। এনলাইটমেন্ট বা রেঁনেসার মানবতাবাদ ধারণা আসার অনেক আগের। এছাড়াও মনে রাখতে হবে হিউম্যানিটির কেন্দ্রীয় ধারণা পরান কাঁদা নয়, রিজন ও বুদ্ধি ওয়ালা মানুষ, সেই মানুষের বন্দনা ও প্রশংসা। সব ক্রেডিট এই মানুষের এবং ব্যক্তি মানুষের।

আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে মানবতাবাদের এই ধারণা আমাদের ভুখণ্ডে এসেছে বামপন্থীদের হাত ধরে। এই ধারণাকে জনপ্রিয় করেছে বামপন্থীরা। মুলত এম এন রায় ভারতবর্ষে এই ধারনার আমদানী করেন এবং নয়া মানবতাবাদ নামে তাঁর নতুন রাজনৈতিক চিন্তাকে জনপ্রিয় করতে ভুমিকা রাখেন। হায় এই ভুখন্ডের বামপন্থীরা, মার্ক্সের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে বলে এরা খোদ মার্ক্সের চিন্তার সাথেই যুদ্ধ করে গেছে চিরকাল, এখনো করছে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter