ভারত ভাগের দায় এবং সেই বিভাগজনিত কারণে কোটি কোটি মানুষের দেশত্যাগ আর রক্তপাতের দায় কংগ্রেস ও স্যেকুলার ইতিহাসবিদেরা একতরফাভাবে মুসলিম লীগের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে।
এই প্রসঙ্গে ১৯৪৬ সালে বৃটিশ মন্ত্রীদের ক্যাবেনেট মিশন প্রস্তাব এবং তৎপরবর্তী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়া আমাদের বিষয়টি নির্মোহভাবে পর্যালোচনায় সাহায্য করবে।
আগে জেনে নেই ক্যাবিনেটি মিশন প্রস্তাব কী ছিল?
১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে বৃটিশ সরকার তিনজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর একটি মিশনকে উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের সর্বসম্মত উপায় উদ্ভাবনের জন্য প্রেরণ করেন। এই তিনজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী হলেন- লর্ড পেথিক লরেন্স, স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস এবং এভি আলেকজান্ডার। স্টাফোর্ড ক্রিপস এই মিশনে নেতৃত্ব দেন।ক্যাবিনেট মিশন এমন কিছু পরিকল্পনা প্রণয়নের চেষ্টা করে যা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই গ্রহণ করবে। ১৯৪৬ সালের ১৬ মে তারিখে মিশন তাদের পরিকল্পনা পেশ করে। পরিকল্পনার প্রধান তিনটি ধারা ছিলোঃ
(১) পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রতি দশ লাখ ভোটার থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে একটি কেন্দ্রীয় গণপরিষদ গঠিত হবে। এই গণপরিষদ ভারতীয় ইউনিয়নের জন্য সংবিধান রচনা করবে।
(২) ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। এই সরকারে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ৫টি করে এবং শিখ ও তফসিলীদের একটি করে মন্ত্রিত্ব থাকবে।
(৩) প্রদেশগুলো তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হবে। বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি গ্রুপ। পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম প্রধান এলাকা নিয়ে আরেকটি গ্রুপ। অবশিষ্ট প্রদেশগুলো নিয়ে আরও একটি গ্রুপ। প্রত্যেকটি গ্রুপ তার নিজের সংবিধান রচনা করার অধিকার পাবে এবং প্রত্যেকটি গ্রুপ প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া বাকি সব বিষয়ে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। প্রত্যেক গ্রুপ আবার দশ বছর পর সংবিধানের পুনর্বিবেচনার সুযোগ পাবে এবং চাইলে পৃথকও হয়ে যেতে পারবে।
ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবে হয়তো ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে ভারত ভাগের কথা থাকলেও, এই প্রস্তাব মানলে কিছুদিন অন্তত একসাথে থেকে ধীরে ধীরে শান্তিপুর্ণভাবে পৃথক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
এই প্রস্তাব ২০ দিনের মধ্যে ৬ জুনে প্রথম সম্পুর্ণভাবে মেনে নেয় মুসলিম লীগ। এর একমাস পরে ৬ জুলাই কংগ্রেস এই প্রস্তাবকে শর্তাধীন স্বীকৃতি দেয়। আবার ১০ জুলাই কংগ্রেসের নতুন সভাপতি নেহেরু এই প্রস্তাব কার্যত প্রত্যাখ্যান করেন। নেহেরুর প্রতিক্রিয়ায় জিন্নাহ বিক্ষুব্ধ ও আশাহত হয়ে ২৯ জুলাই আগে দেয়া স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেন।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অসীম রায় লিখেছেন, ” ইতিহাসের কাঠগড়ায় দেশ-বিভাগের সম্পুর্ন বিরোধী মিশন (ক্যবিনেট)-পরিকল্পনা হত্যার আসামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।”
অথচ কি আশ্চর্য, এই স্বার্থবাজ কংগ্রেস আর চতুর নেহেরু স্যেকুলার ইতিহাসে মহান হিসেবে চিহ্নিত।