এটা খুবই কৌতুহলজনক যে, তৎকালীন পুর্ববঙ্গে যখন কৃষক প্রজা পার্টির এবং পরবর্তীতে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদে তুমুল আন্দোলন করছে তখন কেন এই অঞ্চলের কমিউনিস্টরা জমিদারি প্রথা রেখেই তেভাগার সংগ্রাম করছে?
উনিশশো তিরিশের দশকে ভারতের ইতিহাসে যে অমিত সম্ভাবনার দশক হিসেবে হাজির হয়েছিল-সেই সম্ভাবনাকে কেন ভারতের কমিউনিস্টরা উপলব্ধি করতে পারলোনা সেটার পর্যালোচনা করাটা জরুরী।
তিরিশের দশকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের সাথে শ্রেণীগত দাবি-দাওয়া এবং শ্রেণীসংগ্রামকে মেলাবার কাজ সম্পূর্ণ অন্য পদ্ধতিতে চীন এবং ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি করেছিল। ভারতের পার্টি সেই কৌশলে হয় প্রভাবিত হয়েছে অথবা ভুলভাবে গ্রহণ করেছে। চীন ও ভিয়েতনামের পার্টি মনে করতো; সাম্রাজ্যবাদী শত্রুর মোকাবেলায়, অথবা এমন একটি পরিস্থিতিতে যেখানে সমগ্র সমাজ তাদের শ্রেণী বিভাজন সত্ত্বেও কোনও ঔপনিবেশিক শত্রুর মুখোমুখি হয়, শ্রেণী-সংগ্রামকে ঐ ঔপনিবেশিক বা আধা- ঔপনিবেশিক সমাজের সমস্ত পারস্পরিক শত্রুভাবাপন্ন শ্রেণীগুলির পরস্পরের প্রতি কিছু সুবিধা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমঝোতায় আনতে হয়। এই বিষয়ে চিরায়িত মার্কসীয় ধ্যানধারণা যা মার্কস ও এঙ্গেলস আয়ারল্যান্ড অ্যান্ড দ্য আইরিশ কোশ্চেনে বলেছেন, মাও জে দং তাকেই জাপান-বিরোধী সংগ্রামে সেটাকেই পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
(১) মাও লিখেছিলেন;
“জাপানের মোকাবিলার জন্য শ্রেণী-সংগ্রামকে জাতীয় সংগ্রামের অঙ্গীভূত করা যুক্তফ্রন্টের প্রাথমিক কর্তব্য। একটি জাতি যখন বিদেশী শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত তখন শ্রেণী-সংগ্রাম জাতীয়-সংগ্রাম হিসেবেই প্রতিভাত হয়, এবং দুটির মিলিত রূপও বোঝা যায়। একদিকে, জাতীয় আন্দোলনের ঐতিহাসিক মুহূর্তে বিভিন্ন শ্রেণীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিগুলি এই সকল শ্রেণীর মধ্যেকার সমঝোতাকে বিঘ্নিত না করে পরিচালিত করা-অন্যদিকে জাতীয় সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে থেকেই শ্রেণী-সংগ্রামের দাবিগুলি উত্থাপন করা উচিত।”
“এটা নিশ্চিত জে জাপান-বিরোধী যুদ্ধে সমস্ত কিছুই জাপানকে প্রতিহত করার জন্যেই করতে হবে। সুতরাং শ্রেণী-সংগ্রামের স্বার্থ, প্রতিরোধ সংগ্রামের সঙ্গে সংঘর্ষে না গিয়ে তার অঙ্গীভুত হবে। কিন্তু শ্রেণীগুলির এবং শ্রেণী-সংগ্রামের অস্তিত্ব আছে এবং থাকবে। আমরা শ্রেণী সংগ্রামকে অস্বীকার করি না- একে নিয়ন্ত্রণ করি। জাপানের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হবার জন্য আমাদের এমন একটি উপযোগী নীতি গ্রহণ করতে হবে জাতে শ্রেণী সম্পর্কগুলির মধ্যে কিছুটা সমঝোতা ঘটানো যায়।” (২)
শ্রেণী-সমঝোতা বলতে মাও কী বলতে চেয়েছেন সে বিষয়েও তিনি ব্যাখ্যা করলেনঃ
“শ্রমিক শ্রেণীকে দাবি রাখতে হবে যাতে মালিকপক্ষ তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটায়, কিন্তু পাশাপাশি তাদেরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে জাপানকে প্রতিহত করার জন্যে; জমিদারদের প্রাপ্য খাজনা ও সুদের হার কমাতে হবে, কিন্তু কৃষকদেরও তা শোধ করতে হবে এবং বিদেশী শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।” (৩)
ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টিও ঠিক একই পদ্ধতিতে শ্রেণী-সমঝোতার কথা বলেছে ও নিজের প্রয়োগ করেছে। (ভগবান জোশ, মিনিস্ট্রিজ অ্যান্ড দ্য লেফট) মজার ব্যাপার হল যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও সারা পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামে প্রাথমিক দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব অনুধাবন করে জনযুদ্ধের (peoples’ War) সময়ে শ্রেনী-সমঝোতার প্রয়োগ ঘটাতে চেষ্টা করেছে। (৪)
কিন্তু মাও এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতো না করে, সিপিআই প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক ও হিংসা বা অহিংস পদ্ধতির পারস্পরিক বিরোধের তাত্ত্বিক দিকগুলিকে এড়িয়ে, শ্রেণীসংগ্রামকে টেক্সট পড়া বিদ্যা দিয়ে মেলাতে চেয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বিহারের জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইরত কিষান সভার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক্সবাদী সহজানন্দ সরস্বতী ১৯৩৭-এর কংগ্রেস মন্ত্রীসভার সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্কের ঘোরতর বিরোধী হয়েও ১৯৪২-৪৪-এর আন্দোলনের সময় খোলাখুলিভাবেই কৃষক-সম্প্রদায়কে জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিলেন।
সুতরাং, ভারতীয় কমিউনিস্টদের মতে “শ্রেনী-সমঝোতাটা কোনও বিরোধের বিষয় নয়, বিরোধটা হল কী পদ্ধতিতে একটা উপনিবেশ-সমাজে এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে এই সমঝোতা হবে।”
ভারতীয় কমিউনিস্টরা যুক্তি দিয়েছিল। “আধা-ঔপনিবেশিক দেশে, যেখানে জমিদারশ্রেণী বা তাদের সহযোগীরা ক্ষমতা ভোগ করে, সেখানে সংগ্রামের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও পরিবর্তিত হয়। কখনও-কখনও সামন্ততন্ত্র-বিরোধী সংগ্রাম এবং জমিদার-প্রথার বিলুপ্তির দাবি প্রাথমিক কর্তব্য বলে মনে হতে পারে, কেননা উপনিবেশবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে জনগণের জাগরণ ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াই জরুরি ও প্রধান রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা তখন সম্ভব হচ্ছে না। যেমন, ১৯২২ থেকে ১৯৩৪-এর মধ্যে চীনের সংগ্রামের কথা বলা যায়, যেখানে জনগণের সরাসরি আক্রমণ ছিল যুদ্ধবাজ ও তাদের সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধে এবং ১৯৪৬-৪৯-এর গৃহযুদ্ধের লক্ষ্যও ছিল চিয়াংকাই-শেককে ক্ষমতাচ্যুত করা। উভয়-ক্ষেত্রেই, কৃষক –আন্দোলনই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। অন্যদিক, যখন উপনিবেশ-শক্তি সরাসরি শাসন করে বা ভীতির কারণ হয় তখন সেই শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সংঘবদ্ধ করাটাই জরুরি কাজ হওয়া উচিত এবং সেক্ষেত্রে জমিদারতন্ত্র বিলোপের জন্য আন্দোলন চালানোও হয় না। প্রত্যাহার করাও হয় না। এইরকমটি হয়েছে চীন দেশে ১৯১৮-১৯ এবং ১৯৩৭-৪৫-এর মধ্যে এবং ভিয়েতনামে ১৯৩৯-এর পর থেকে।
ভারতবর্ষে উপনিবেশ-শক্তি সরাসরি শাসন করেছে। ভারতবর্ষে সামাজিক শ্রেণিগুলির কোনওটিই রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশগ্রহণ করেনি। সুতরাং, জমিদার-প্রথার পুরোপুরি বিলুপ্তি অথবা কৃষি-বিপ্লবের দাবি অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। বরং শুধুমাত্র জমিদারতন্ত্রের কঠোর অবস্থার শক্তিহ্রাস করাটাই একমাত্র বৈপ্লবিক দাবি হতে পারত।” (৫)
উপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকালে শ্রেণী সমঝোতা নিয়ে মাও-কে নজির হিসেবে দেখানো ভারতীয় কমিউনিস্টদের জন্য একটা রেওয়াজ হয়ে ওঠে। যে বিষয়টি তারা বিবেচনায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল তা হল জাপানি সাম্রাজ্যবাদ যখন চীনে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং জমিদাররা ও সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সমর্থক নয় তখনই মাও শ্রেণী সমঝোতার কথা বলেছেন। এমনকি সেই সময়েও মাও তাদের কাছে একটি সুচিন্তিত কর্মকৌশল প্রবর্তন ও প্রচার করেছেন এবং মাও কখনই কৃষি-বিপ্লবের লক্ষ্যচ্যুত হননি।
অথচ ভারতে কৃষি –বিপ্লব কখনই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশের মধ্যে ছিল না, তা গৌণ কিংবা মুখ্য কোনও অভিষ্ট হিসাবেই নয়। উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদ এখানে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ছিল জমিদারদের সক্রিয় সমর্থনে-কেবল ব্যক্তিগত নয়, তাদের শ্রেণী সংগঠনেরও সমর্থনে। যদি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-ই একমাত্র বিষয় হত তবে যে ধরনের শ্রেণী সমঝোতার পক্ষে কমিউনিস্টদের তরফ থেকে সওয়াল করা হয়েছে তা ১৮৫৭ সালে ভারতীয় জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে এবং যার চূড়ান্ত পরিণতি রাজা-রাজড়া ও জমিদারদের সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পণ এবং কৃষকসমাজকে আরও শোষণের শিকার করা।
আরো কৌতুহল উদ্দীপক বিষয় হচ্ছে বাঙালি মার্ক্সবাদী মহল বরং জমিদারি প্রথার ঘোর সমর্থক ছিলেন। এর একটা বড় কারণ, সেই প্রথম প্রজন্মের কমিউনিস্টরা এসেছিল জমিদারি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। তারা পুজিতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন বটে তবে পুজিবাদের সেই ক্রিটিক তারা করতেন ফিউডাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। তার মানে, আমি পুজিবাদ চাইনা, কারণ পুজিবাদ আমার জমিদারিকে অসম্ভব করে তুলছে।
বাংলার প্রথম মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী বিনয়কুমার সরকার একটা বই লেখেন, তার নাম বাংলার জমিদার। সেই বইয়ে তিনি বলার চেষ্টা করেন, এই জমিদার প্রথার মধ্যে দিয়েই বাঙলায় একটা ক্যাপিটালিজম তৈরি করা সম্ভব। তার বইয়ের কিছু চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য দিলাম।
বাংলার জমিদার থেকে নির্বাচিত অংশঃ (৬) অনেক বিষয়ে বাঙলার জমিদারেরা যথেষ্ট সৎ-শিক্ষার, সচ্চরিত্রতার, নিঃস্বার্থতার পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালী সমাজ, বাঙলার গ্রাজুয়েটগণ, বঙ্গীয় শিক্ষিত সম্প্রদায়, বঙ্গের নেতৃগণ বহু বিষয়ে জমিদারদিগের সাধুতা ও মহত্ত্বের নিকট ঋণী।
বাঙালী জমিদার সৃষ্টি-ছাড়া জীব নয়। জমিদার-প্রথা জগতের অন্যান্য দেশেও আছে। ১৯১৪ হইতে ১৯২৫ পর্যন্ত সাড়ে এগার বৎসর ধরিয়ে ইয়োরামেরিকায় আর এশিয়ায় ও আফ্রিকায় রকমারি জমিদার-সম্প্রদায়ের সঙ্গে মোলাকাৎ ঘটিয়েছে। তাহা ছাড়া দুনিয়ার সর্ব্বত্র জমিজমার আইনকানুন পূর্বে কেমন ছিল, আজকাল কেমন আছে তাহাও বিস্তৃতরূপে বুঝিয়া দেখিবার সুযোগ জুটিয়াছে। এই সকল বিষয়ে “বর্তমান জগৎ” গ্রন্থাবলীর বার খন্ডে নানা উপলক্ষ্যে আলোচনা করা গিয়াছে। ১৯২৫ সনের শেষাশেষি দেশে ফিরিয়া আসিবার পর দেশ-বিদেশের জমিদারিপ্রথার একাল-সেকাল সম্বন্ধে লেখালেখি ও বক্তৃতাদি চালাইয়াছি। এক কথায় বলিতে পারি যে, বাঙালী জমিদার-দিগকে অন্যান্য দেশের জমিদারদের তুলনায় কোনো হিসাবে খাটো বিবেচনা করিবার কারণ ঢুঁড়িয়া পাই নাই। চীনা, জাপানী, ইতালিয়ান, ফরাসি, জার্ম্মান ও ইংরেজ জমিদারদের সংস্রবে আসিলে বাঙালী হিসাবে কাহাকেও অপ্রতিভ বনিয়া যাইতে হইবে না। বাঙালী সমাজের পক্ষে, বাঙালী জমিদারদের পক্ষেও ইহা একটা গৌরবের বস্তু।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে, কাল হিসাবে বাঙালী জাতির সর্ব্বপ্রথম পুজি-কেন্দ্র জমিদার-শ্রেণী। সেকালের বাঙালী বণিকদের পুঁজিনিষ্ঠা আজও বেশ পরিস্ফুট নয়। একালের বঙ্গসমাজের অন্যান্য শ্রেণী লোকও পুঁজিপতি রূপে দেখা দিয়াছে। কিন্তু রামমোহনের যুগ হইতে ভূদেব এবং ভূদেবের যুগ হইতে বিবেকানন্দ, রামেন্দ্রসুন্দর ও আশুতোষের যুগ পর্য্যন্ত জমিদারের পুঁজি বরাবর বাঙালী জীবনের আলতে গলিতে প্রধান রুধির জোগাইয়া চলিয়াছে। এই জোগানের কথা অর্থশাস্ত্রী সমাজশাস্ত্রী ও রাষ্ট্রশাস্ত্রীদের চিন্তায় ও গবেষণায় যথোচিত ঠাঁই পাইবার যোগ্য। বিশেষতঃ আগামী ভবিষ্যতের জন্য যাঁহারা বাঙালী জাতিকে গরিয়া-পিটিয়া তুলিবার কাজে মোতায়েন আছেন তাহাঁদের পক্ষে বাঙালী জাতির এই সনাতন পুঁজি-কেন্দ্রে জমিদার-সম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সহযোগিতার কথা বিজ্ঞান-সম্মত রূপে আলোচনা করিয়া দেখা আবশ্যক।
চাই জমিদারের জন্য নতুন-নতুন পেশা
“কেজো” কর্ম্মতৎপর জমিদার প্রত্যেক জেলায় দু’চারজন আছেন ধরিয়া লইলাম। প্রকৃতপক্ষে যদি এইরুপই হয় তথাপি এই সকল “কেজো” জমিদারের আত্মীয় –স্বজন ও বংশধরেরা অনেক ক্ষেত্রেই নিষ্কর্মা। জমিদারদের সন্তানগণকে নানাপ্রকার অর্থকর কজে লাগাইবার ব্যবস্থা করা স্বদেশ- সেবকদের একটা বড় ধান্ধা হওয়া উচিত। দেশের আর্থিক উন্নতির জন্য এই সকল লোককে উপযুক্ত কর্ম্মক্ষেত্রে মোতায়েন রাখিবার দিকে বিশেষ নজর রাখা বাঞ্ছনীয়।
“(১) কৃষিক্ষেত্রের কাজ। -জমি লইয়া চাষবাস করা জমিদারদিগের আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে বোধ হয় সর্ব্বাপেক্ষা সুবিধাজনক ব্যবসা। যে-কোন লোকই একশত বিঘা বা ততোধিক পরিমাণ জমি লইয়া কৃসি-মজুরদের দ্বারা কাজ আরম্ভ করাইতে পারেন। এজন্য চাই প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা করিয়া নিয়মিতভাবে আবাদে গিয়া ম্যনাজারের মত দেখা-শুনা করা। কৃষিকার্য্যকে লাভজনক করিয়া তোলাই হবে প্রধান ধান্ধা। পৈতৃক সম্পত্তি হইতে ক্রমান্বয়ে প্রাথমিক পুঁজি লওয়া তাহাদের পক্ষে সম্ভব সন্দেহ নাই।
“(২) আধুনিক শিল্পকর্ম।– “সেকেলে” কারিগরগণের দ্বারা চালিত হস্তশিল্প বা কুটিরশিল্প ছাড়া অনেক নয়া নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠা দেশোন্নতির জন্য আবশ্যক। জমিদার সন্তানদের “ক্ষুদ্র কারবারে” লাগিয়া যাইতে চেষ্টা করা কর্ত্তব্য।
“(৩) বহির্ব্বানিজ্য।–আর এক প্রকার কাজ হইতেছে আমদানি ও রপ্তানি। রাজধানীতে বা জেলা ও মহকুমা সদরে এই কাজ চালাইতে পারা যায়।
“(৪)বীমা।– একটি বড় লাভের পথ বীমা-ব্যবসা। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতবাসী বিশেষতঃ বাঙালী এখনও সেদিকে যথোচিত রূপে মনোনিবেশ করেন নাই। তবে ইতোমধ্যেই ভারত-সন্তানের ইজ্জৎ বিমা-ব্যবসায় বেশ পাকিয়ে উঠিয়াছে। জমিদারের আত্মীয়গণ ইনশিওর্যান্স্ আফিস নিজেরাই চালাইতে পারেন। এই সমস্ত আফিসের এজেন্ট হইলেও তাহাঁরা নতুন-নতুন কর্ম্মক্ষেত্রের সন্ধান পাইবেন।
“(৫) ব্যাঙ্ক।–জমিদারের আত্মীয়-স্বজনেরা নানা শ্রেণীর ব্যাঙ্ক স্থাপন করিতে পারেন। তাহার সাহায্যে (১)সমবায় ঋণদান সমিতি(চাষী-ব্যাঙ্ক), (২) হস্ত ও কুটির শিল্প এবং (৩) খুচরা ব্যবসা-বানিজ্য অনেক পরিমাণে লাভবান হইতে পারে। আরও দু’এক প্রকার ব্যাঙ্ক জমিদারের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। এইগুলি (১) বৈদেশিক বানিজ্য, (২) “আধুনিক” শিল্প এই দুই শ্রেণীর ব্যবসায়ে অর্থ সাহায্য করিতে পারে। এই দুই প্রকার ব্যাঙ্ক জমিদারের পক্ষে আয়-বৃদ্ধির সদুপার। এদিকে নজর ফেলা আবশ্যক।
“ বিশেষ দ্রষ্টব্য।–জমিদারের সম্প্রদায় পুঁজিবিহীন নন। তাঁদের আজ আবশ্যক “ খাটিয়া খাওয়ার” প্রবৃত্তি, আর অন্যান্য লোকজনের মতনই মানুষের মতন মেহনৎ করা। এই সকল সদগুণ তাঁহাদের জীবনে বাড়িতে থাকিলেই চাষ-আবাদের কাজে কর্ম্ম-কর্ত্তা, ব্যাঙ্ক-ইনশিওর্যান্স কোম্পানীর পরিচালক আর আমদানি-রপ্তানি আফিসের এবং শিল্প-কারখানার নানা প্রকার ম্যানাজার হইবার দায়িত্ব লওয়া তাঁহাদের পক্ষে বেশী পরিমাণে সম্ভব হইবে।”
নতুন ঢঙের জমিদার
“কিন্তু চাষবাসকে এঞ্জিনিয়ারিং আর রসায়নের আওতায় আনিয়া ফেলিতে পারিলে বাঙলায় কৃষিকর্ম্ম নবীন ধন-দৌলতের সূত্রপাত করিবে। শত শত বা হাজার হাজার বিঘার মালিকেরা নয়া ঢঙের জমিদার দাঁড়াইয়া যাইতে পারিবেন। এই বিষয়ে যুবক বাঙলার মাথা খেলানো অন্যায় হইবে না।
“প্রথমেই চাই যন্ত্রপাতি। তারপর চাই সার। আমাদের গোবরের সারে আর চলিবে বলিয়া বিশ্বাস হয় না। বাঙলার গরুগুলা খায় কি? তার আবার গোবরের কিস্মৎ কতটুকু? চাই রাসায়নিক সার। এই দুয়ের জন্য নগদ টাকা ঢালিতে হইবে-বলাই বাহুল্য।
এই অভ্যাসটা আমাদের বাঙালী জমিদার সমাজে পয়দা হইয়া গেলে চাষ-ব্যবসাটা আধুনিক লাভ করিতে পারিবে। আর সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকর্ম্মে প্রচুর উপার্জ্জনও চলিতে থাকিবে। তবে এই ব্যবসা সাধারণ লোকের হাড়ে পোষাইবে না। সে সকল ব্যক্তি উপার্জ্জনের কথা না ভাবিয়া দুই চার বৎসর টাকা ঢালিতে পারেন, একমাত্র তাঁহাদের পক্ষে এই ধরণের নবীন চাষ বাঙালী জাতিকে উপহার দেওয়া সম্ভব।”জমিদারেরা একমাত্র চাষীদের মারফৎ গৌণভাবে কৃষিকার্য্যের পুষ্টিসাধন করিয়াই ক্ষান্ত নয়। মুখ্যভাবে নয়া নয়া শিল্পের কারখানায় আর নয়া নয়া ব্যবসা-বানিজ্যের কারবারে পুঁজি ঢালিবার রেওয়াজ জমিদারদের চরিত্রে বহুদিন ধরিয়াই দেখা যায়।
আর এক প্রকার জমিদার হইতেছেন রক্তের গুণে আসল ব্যপারী। অর্থাৎ তাঁহারা ব্যবসাদার জাত (সুবর্ণবণিক, সাহা, তিলি ইত্যাদি)। পয়সার জোরে তাঁহারা জমিদারি কিনিয়াছেন। কিন্তু জমিদার বনিয়া যাইবার পরেও তাঁহারা জাত-ব্যবসা অর্থাৎ কারবার চালানো পরিত্যাগ করেন নাই। টাকার লগ্নি কারবার ইত্যাদি সুপ্রচলিত ব্যবসা ছাড়াও তাঁহারা ক্রমে নতুন-নতুন ব্যাঙ্ক, আমদানি-রপ্তানির প্রতিষ্ঠান, জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানী ইত্যাদি কায়েম করিতে অগ্রসর হইয়াছেন।
পাঠক নিশ্চয় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন রাসায়নিক সারের প্রতি বিনয়সরকারের মতো মার্ক্সবাদীর মাত্রারিতিক্ত অনুরাগ। সম্ভবত এই কারণেই সার বীজ আর কীটনাশকের জন্য সিপিবি এখনো আন্দোলন করে। তিনি মুলত এঙ্গেলস থেকে মার্ক্সবাদের পাঠ শুরু করেছিলেন এবং সম্ভবত তিনি মার্ক্স পুরোটা পড়তে পারেন নাই। এখনো যেমন মার্ক্সবাদী দেখি বিনয়কুমার সরকার তাঁদের সার্থক উত্তরপুরুষ এতে কোন সন্দেহ নাই।
তথ্যসুত্র ও টোকাটুকিঃ
১/ মাও জে দং, সিলেক্টেড ওয়ার্ক্স, খণ্ড ২, লণ্ডন ১৯৫৪, পৃষ্ঠা ২৬৪
২/ মাও জে দং, সিলেক্টেড ওয়ার্ক্স, খণ্ড ২, লণ্ডন ১৯৫৪; পৃষ্ঠা ২৫০
৩/ মাও জে দং, সিলেক্টেড ওয়ার্ক্স, খণ্ড ২, লণ্ডন ১৯৫৪;পৃষ্ঠা ২৬৩
৪/ করেস্পনডেন্স বিটুইন মহাত্মা গান্ধী অ্যান্ড পিসি জোশি, পৃষ্ঠা ১২
৫/ তিরিশের দশকে জাতীয় কংগ্রেসে মতাদর্শগত রুপান্তরের সংগ্রাম; বিপান চন্দ্র, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৮; অক্টোবর ১৯৯৬, সেরিবান
৬/ বাংলার জমিদার; বিনয়কুমার সরকার, পুরাতনি গ্রন্থমালা; সেরিবান