দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে তিনটা উল্লেখযোগ্য ওষুধ উৎপাদক কোম্পানি ছিল- ফার্মাপাক, এড্রুক ও অ্যালবার্ট ডেভিড। এছাড়া যে সব ওষুধ কোম্পানি ছিল, তাদের ওষুধের পরিমাণ এবং মান উল্লেখ করার মতো ছিল না। এই কোম্পানিগুলো সাকুল্যে ২০% স্থানীয় ওষুধের চাহিদা মেটাত। অ্যালবার্ট ডেভিড-এর মালিক ছিলেন অবাঙালি। তিনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে চলে যান। আড্রুক পড়েন মূলধন সংকটে। ‘ফার্মাপাক’-এর নাম বদল করে নাম দেন ‘ফার্মাদেশ’। বাকী যে ৮০% ওষুধের প্রয়োজন হতো, সেটা আসতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। এর মধ্যে একটা পাকিস্তানি কোম্পানি ছিল; নাম ‘ফিরোজ অ্যান্ড সন্স’। বাকী সব ওষুধ আসতো বহুজাতিক কোম্পানি থেকে, যাদের অফিস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। হঠাৎ করে দু’টো স্থানীয় কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ওষুধ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সদ্য স্বাধীন দেশ ওষুধের তীব্র সংকটে পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকায় সেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সদ্য স্বাধীন দেশে ওষুধ বিক্রিতে অনীহা দেখায়।
সেই সময় একটা কমিটি করা হয়, যারা সরকারকে পরামর্শ দেয় তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে থেকে ওষুধ কেনার। কমিটিতে ছিলেন, প্রফেসর নুরুল ইসলাম ও প্রফেসর আশরাফ আলী। সেই সময় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ওষুধ উৎপাদন প্রযুক্তি ছিল হাঙ্গেরির। ‘কমেকন’-এর সদস্য হিসেবে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো হাঙ্গেরিকে ওষুধ শিল্পে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দায়িত্ব দিয়েছিল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের চাহিদার ৬০% ওষুধ হাঙ্গেরি থেকে নিতো। সমস্যা ছিল একটাই, বাংলাদেশ ওষুধের দাম বৈদেশিক মুদ্রায় শোধ করতে সক্ষম ছিল না।
এই কঠিন মুহূর্তে এগিয়ে এলো হাঙ্গেরি। হাঙ্গেরির ইগিস, গেইডেন রিখটার, কাইরন, মেডিম্পেক্স। তারা রাজি হলো বার্টার ট্রেডে। ওরা পাঠাবে ওষুধ আর আমরা বিনিময়ে পাঠাবো পাট ও কাঁচা পণ্য। ওষুধের মূল্য ধরা হলো এক্স ফ্যাক্টরি প্রাইসে। অর্থাৎ মূল উৎপাদন খরচ।
সেই চড়াইয়ের দিনে অন্য কোনো দেশ আমাদের পাশে না দাড়ালেও, মুনাফার চিন্তা না করে দাঁড়িয়েছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। সমাজতন্ত্র শুধু ক্ষমতার রাজনীতিই নয়, এক মহান আদর্শও বটে। যেই আদর্শ পৃথিবীকে মানুষ আর মানবিক মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে শিখিয়েছিল।