ইমরান খান কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন?

ভুট্টো পরিবার ও নাওয়াজ পরিবারের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে একজন মানুষ যখন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বচনে দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে! তখন এই সাফল্য বড় করে উদযাপন করা উচিত ছিলো পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়; যে অঞ্চলটিতে পরিবারতন্ত্রের অভিশাপে যুগ, যুগ ধরে সকল অধিকার হারিয়ে বসে আছে জনগন। অথচ, ইমরান খান পাকিস্তানের নির্বাচনে জয়ী হবার পর থেকেই বাংলাদেশের চেতনাশিবির, এই রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে দুঃখজনক ভাবে মিথ্যাচারের উপরে ভিত্তি করে প্রচারনায় নেমেছে।

তাঁদের প্রচারণায় মুল ফোকাস হচ্ছে, ইমরান খান নাকি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণা করেছে। কচি, মাঝারি এমনকি বুড়া স্যেকুলারপন্থিরা কোমড় বেধে কোন রেফারেন্স ছাড়াই এই প্রচারণার পালে বাতাস দিচ্ছে। এরা এমনকি এটাও দাবী করেছিল ইমরান খান জেনারেল নিয়াজীর ভাতিজা।

ইমরান খান ২০১১ সালে Pakistan: A personal History নামে একটা বই লেখেন, বইটা প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ড থেকে। সেই বইয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা অংশ লেখেন। যখন মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছিলো তখন ইমরান খান একজন সদ্য কৈশোর উত্তির্ণ তরুণ। আমার বিবেচনায় একজন পাকিস্তানি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার মূল্যায়ন ফেয়ার এবং ডিসেন্ট। আসুন আমরা আগে বাঙলা অনুবাদে পড়ে নেই তিনি কী লিখেছিলেন।

“১৯৭০ এর নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তানের দল আওয়ামী লীগ (যারা পুর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছিলো) সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসলে বিজয়ী হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয়ী হয়েছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টি পিপিপির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো; তিনি সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন।

পুর্ব পাকিস্তানের জনগণ শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তানকে তাঁদের ভোটের ফলাফলকে অসন্মান করতে দেখে বিদ্রোহ করে। রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খান ভিন্নমত পোষণ কারীদের দমন করার জন্য সেনা পাঠান। সেই একই সেনাদের তিনি ভিন্নমত দমনের কাজে পাঠান, যারা কিছুদিন আগেই একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কাজ করেছিল। সেনারা যখন পুর্ব পাকিস্তানে পৌছালো তখন ভুট্টো ঢাকা থেকে করাচিতে ফিরে এসে উচ্ছসিতভাবে ঘোষণা করলেন, “পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে”। কিন্তু এই সামরিক অভিযানের ফলে এক ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল যেখানে হাজারে হাজারে বেসামরিক লোক মারা গিয়েছিল, লাখে লাখে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল।

আমি সেনা অভিযানের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের আন্ডার ১৯ ক্রিকেট দলের সদস্য হিসেবে পুর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা শেষ বিমানের যাত্রী ছিলাম। আমরা যখন পুর্ব পাকিস্তান দলের সাথে খেলছিলাম তখন আমরা আমাদের প্রতি তাঁদের শত্রুতার উত্তাপ টের পাচ্ছিলাম। এটা যে শুধু ঢাকা স্টেডিয়ামের দর্শকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, আমাদের প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যেও একই আচরণ ছিল। পুর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আশরাফুল হক, যিনি পরবর্তীতে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিনত হন, তিনি সেদিন রাতেই ডিনারে বলেছিলেন কেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এখানে জনমত এতো প্রবল। তিনি বলেছিলেন, তার মতো অনেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চাইতেন যদি তাঁদের প্রাপ্য অধিকার দেয়া হতো, তবে কিছুই কানে না তোলায় এখন সেই অধিকারের দাবী একটা শক্তিশালী স্বাধীনতার সংগ্রামে রুপান্তরিত হয়েছে। আমি এটা শুনে বজ্রাহত হলাম; পশ্চিম পাকিস্তানের মিডিয়া সেন্সরশিপের কারণে পুর্ব পাকিস্তানের মানুষের অনুভুতি সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই ছিলনা। তবে আমার মতো অনেকেরই কল্পনাতেও আসেনি যে দেশটা ভেঙে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে।

পশ্চিম পাকিস্তান এরপরে একের পর এক মারাত্মক ভুল করে ভারতকে তার পুর্ণ সুযোগ নেয়ার অবকাশ করে দেয়। সেইসময়ে ভারতের নেতৃত্ব ছিল নেহেরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর; তিনি বাঙালি বিদ্রোহীদের সমর্থনে সেনা পাঠান। এবারের ফলাফল ভারতের সাথে পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের মতো হয়না। পাকিস্তান দ্রুতই পরাজিত হয়। আমাদের সেনারা এক লজ্জাজনক আত্মসপমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেন। আর ভারত ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে তাদের দেশে নিয়ে যায়। আমাদের দেশ দুইভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং পুর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে রুপান্তরিত হয়। ইন্দিরা গান্ধী জিন্নার পাকিস্তানের ধারণাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে তার পিতার চাইতেও অধিক মুন্সিয়ানা দেখান। পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল এই উপমহাদেশের মুসলমানদের আবাসস্থল হিসেবে। কিন্তু এই তিক্ত গৃহযুদ্ধ, আমাদের সেনাবাহীনিকে আজো তাড়িত করে এমন একটা বেদনাদায়ক পরাজয়ের পরে পাকিস্তান হয়ে রইলো শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের আবাসস্থল।

এর কিছুদিন পরে আমার আবার আশরাফুল হকের সাথে দেখা হল, যে পরিমানে বেসামরিক বাঙালি সামরিক অভিযানে নিহত হয়ে বলে তার কাছে জানলাম, আমি তাতে বজ্রাহত হলাম। দুইতরফেই যেই সংখ্যার কথা বলা হয়েছে তা নিশ্চিত করা দুরূহ কিন্তু এটা খুবই সম্ভব যে কয়েক মাস ধরে চলা গৃহযুদ্ধের কারণে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং নিরাপত্তার কারণে লাখে লাখে মানুষ ভারতে পালিয়ে গেছে।

আমি এর আগে আমার সমসাময়িক ভারতীয় আর ইংরেজ বন্ধুদের সাথে এই বলে তর্ক করেছিলাম যে এটা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে একটা প্রোপাগান্ডা। কিন্তু আশরাফুলের ভাষ্য শোনার পরে আমি শপথ নিয়েছি আর কখনো নিজ নাগরিকের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান নিয়ে আমার সরকারের প্রচারে আস্থা রাখবো না।

আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার তখম সবেমাত্র শুরু হয়েছিল- আমি ১৯৭১ এর সামারে পাকিস্তানের পক্ষে আমার প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে; সেখানে আমি পাকিস্তানের সেন্সরড মিডিয়া ও সরকারী টেলিভিশন থেকে দূরে ছিলাম। আমি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম গুলো দেখতে পারতাম। পাকিস্তানের পরাজয় দেখার বেদনা আরো মর্মান্তিক হয়ে উঠলো যখন তার উপরে আমাদের সেনাদের চালানো গনহত্যার দৃশ্যগুলো দেখানো হচ্ছিলো।

এই মর্মবেদনা আরো তীব্র হয়েছিল এই কারণে যে, সরকার এবং সেনাবাহিনী বলে আসছিলো তাঁরা শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়ে যাবে। আত্মসমর্পনের মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে আমার ট্রাইবের একজন সদস্য জেনারেল নিয়াজী যিনি পুর্ব পাকিস্তানের সেনা কম্যান্ডার ছিলেন তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বিবিসিকে একটা সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনী শেষ মানুষ পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখবে। পাকিস্তানি সেনাদের এই আত্মসমর্পন গভীর হতাশার সৃষ্টি করেছিল এবং দেশের উপরে জনগণ বিশ্বাস হারিয়েছিল। অনেকের মতোই আমি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস এনেছিলাম যারা বাঙালি যোদ্ধাদের সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গি, বিদ্রোহী এবং ভারত সমর্থিত যোদ্ধা বলে জানতাম- যা এখনো ব্যবহার তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হয় যারা পাকিস্তানের ট্রাইবাল এলাকা বেলুচিস্তানে লড়ছে ।“

যেই বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের বিচার করতে অপারগ হয়, বাংলাদেশের নায্য পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হয়, আটকে পড়া পাকিস্তানীদের ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়। সেখানে বাংলাদেশের বাঙালি জাতিবাদী রাজনীতিতে পাকিস্তান নামচিহ্ন আছে এমন শত্রুর উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন দরকার। যেন বারেবারে পাকিস্তান ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে সেই আদিপাপ থেকে আমাদের শাসকদের মুক্তি দেয়, তাঁরা যেন বারেবারে সেই নামচিহ্নকে ক্রুসবিদ্ধ করে নিজে নিস্পাপভাবে পুনরুত্থিত হয়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter