দেরিদার ডিকন্সট্রাকশনকে সাহিত্য, শিল্প আর দর্শনের তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করলেও দেরিদা নিজে এটাকে পলিটিক্যাল প্রাকটিস বলেছেন। এই জটিল বিষয়টা বুঝতে বুঝতে আমার মতো মধ্য মেধার মানুষের অনেক কাঠ খড় পুড়াতে হয়েছে। দেরিদার ডিকন্সট্রাকশন দিয়ে অনেক জটিল সামজিক বিষয়কে চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ডিকন্সট্রাকশনের বাঙলা করা হয়েছে “বিনির্মাণ”। বিনির্মাণ শব্দের অর্থ বাঙলা অভিধান অনুসারে, বিরচিত বা কৃত অথবা কর্তৃক রচিত। কোন অর্থেই নির্মাণ বা কন্সটাকশন সংক্রান্ত নয়। ডিকন্সট্রাকশনের বাঙলাটি বুঝে করা হয়নি।
ডিকন্সট্রাকশন কী? এটা বরং বাংলায় বললে দুর্বোধ্য হবে। ইংরেজিতে এক লাইনে দেরিদার ডিকন্সট্রাকশনের চমৎকার সংজ্ঞা দেয়া যায় “ডিসেন্টারিং উইথ আন ম্যসাকিং দ্য প্রব্লেম্যাটিক নেইচ্যা(র) অব অল সেন্টারস”।
প্রশ্ন হচ্ছে, ডিসেন্টারিং কী, সেন্টার কী আর সেন্টারের প্রব্লেম ই বা কী?
ধরুন সমস্ত পাশ্চাত্য চিন্তা কোন একটা কেন্দ্রের আইডিয়া বা সেন্টার কে – একটি উৎস কে, একটি শাশ্বত ফর্মকে একটি অনড় বিন্দুকে, একটি ইমমুভেবল মুভারকে, একটি নির্যাস, একটি ঈশ্বর, একটি অস্তিত্ব কে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই ভিত্তিটাকে দেরিদা বলেছেন সেন্টার। এই সেন্টারকে ব্যবহার করা হয় আর সবকিছুকে অর্থ দেয়ার জন্য। যেমন ২০০০ বছর ধরে পাশ্চাত্য চিন্তা খ্রিস্টানিজম কে সেন্টার করে আবর্তিত হয়েছে। খ্রিস্টানিজম ঠিক করেছে গ্যালিলিও ঠিক বলছে কিনা। একই জিনিস ঘটেছে অন্যান্য সভ্যতার ক্ষেত্রেও।
এই সেন্টারের সমস্যা হচ্ছে, সে অন্য সব কিছুকেই এক্সক্লুড করে, মার্জিনালাইজ করে, রিপ্রেস করে। যেই সভ্যতায় খ্রিস্ট কেন্দ্র তৈরি করে সেই সভ্যতা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, ইহুদী সবাইকে এনি বডি ডিফারেন্ট তাকেই মার্জিনালাইজ করবে বা করে, এটাই সেন্টারের চরিত্র। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের মার্জিনালাইজ করে। এই এনিবডি ডিফারেন্ট কে দেরিদা বলছেন বাইনারি অপজিট। যেমন, পুরুষ কেন্দ্রের বাইনারি অপজিট নারী। এই বাইনারি অপজিটের একটি সেন্ট্রাল আরেকটি মার্জিন্যাল। সেন্ট্র্যাল সবসময় মার্জিন্যালের বা বাইনারি অপজিটের আদার মেম্বারের ফ্রি প্লে বন্ধ করে দেয়।
এই ফ্রি প্লে টা বুঝতে আসুন সাহিত্যের আশ্রয় নিই। জীবনানন্দের বনলতা সেনের রূপ বর্ণনায় জীবনানন্দ কী কী বলেছেন? উনি চুলের কথা বলেছেন, মুখের কথা বলেছেন, চোখের কথা বলেছেন। তার অর্থ রূপ ধারণার সেন্ট্রাল হচ্ছে এই তিনটা বিষয়। এই সেন্ট্র্যাল রূপের প্রতিভু আর যা যা হতে পারতো সেগুলোর চিন্তার ক্ষেত্রই (অর্থাৎ ফ্রি প্লে) বন্ধ করে দিল। বাস্তবিক অর্থে জীবনানন্দও ডিকন্সট্র্যাকশন করেছেন। মধ্য যুগের “দেহি পদপল্লব মুদারম” এর মত পদ যুগলে সৌন্দর্য খোঁজেন নি। ডিকন্সট্র্যাকশন সেই মার্জিনালাইজড কে খুঁজে বের করে, সেন্টারকে অবদমন করে, মার্জিন্যালাইজড কে সেন্ট্রাল করে অন্য অর্থ খোজে।
সমাজতন্ত্র ও ডিকন্সট্যাকশন। এক সেন্টারকে ছুড়ে ফেলে আরেক সেন্টারের রাজত্ব। তাই সমাজতন্ত্রও রিপ্রেসিভ হয়ে উঠেছিল। কারণ সেন্টারের চরিত্র ই তো তাই।
ডিকন্সট্যাকশন ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলেছে স্থাপত্য তে, পেইন্টিং এ, ফ্যাশন এ সাহিত্যে। ছবিটি স্থাপত্যের ডিকন্সট্যাকশন। প্রচলিত স্থাপত্যের যে অংশটি প্রধান নয়, যেই অংশে আমাদের দৃষ্টি পড়েনা, সেটাকেই মুল কাঠামো করে তোলা হয়েছে।
আমাদের দেশে পরিবারতন্ত্র এবং তাকে ঘিরে যে ক্লায়েন্ট প্যাট্রন রিলেশন গড়ে উঠেছে, সেটা আমাদের সামাজিক সম্পর্কের সেন্ট্র্যাল। এই রিলেশনের বাইনারি অপজিট যেগুলো সেগুলো রিপ্রেসড হবেই; এখানে মেধা অবদমিত হবেই, গণতান্ত্রিক প্র্যাকটিস অবদমিত হবেই, ন্যায় অবদমিত হবেই, মানবসত্তার মর্য্যাদা অবদমিত হবেই।
2 thoughts on “দেরিদা-১”
বাংলিশ না হলে খুবই ভালো হতো
Can you say What are the main approaches of Deconstruction theory