সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রীক দেবী থেমিসকে শাড়ি পরিয়ে দিয়ে তাঁর এক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। পানিতে সাদা শাপলা ফুটে আছে, আর ওর মধ্যে দেবী দাঁড়িয়ে আছেন। ডান হাতে তলোয়ার বাঁ হাতে ওজনদাঁড়ি।
এটা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপিত। ভাস্কর সম্ভবত বোঝাতে চাইছে আমাদের বিচারকরা শাড়ি পরা গ্রিক দেবীর অনুসারী, দেবীর স্বর্গীয় ও আইন আর আদেশ কার্যকর করাই আমাদের বিচারকদের কাজ। শিল্পকলা বা ভাস্কর্যের নামে বিচারক ও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে হেয় ও অপমান করবার এই দৃশ্য এখন থেকে নিত্যদিন বাংলাদেশের মানুষ দেখবে; আর যারা এই ভাস্কর্য দেখবে শাড়ি পরা গ্রিক দেবীর প্রতি তাদের ভক্তি আরো নিবিড় হবে, এটাই হয়তো তাঁদের আশা।
কার মাথায় সুপ্রিম কোর্টে শাড়ি পরা গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য স্থাপনের মারাত্মক দামী বুদ্ধি এসেছিল জানি না। তবে বাংলাদেশের জাতিবাদী সাংস্কৃতিক চেতনার দারুণ একটি নজির এটা। গ্রিক পুরাণে বারো জন টাইটানদের একজন থেমিসকে শাড়ি পরিয়ে দিলেই তিনি আমাদের হয়ে যাবেন, আর তাঁর কাছ থেকে স্বর্গীয় আইন-কানুন শিখে ও আদেশ পেয়ে আমাদের বিচারকরা বিচার করবেন। এটা তো দারুন আইডিয়া!
হেফাজত এই ভাস্কর্যের অপসারন চেয়েছে। আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের কমতির কারণে আমরা এই ভাস্কর্যের মাজেজা আগে বুঝি নি, এখন ইমান ও আকিদার জায়গা থেকে হেফাজত প্রতিবাদ করেছে দেখে আমাদের টনক নড়েছে।
স্যেকুলারদের অনেকেই হেফাজতের এই দাবীতে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, হেফাজত এই ভাস্কর্য অপসারনের দাবী তুলে দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে, শিল্পকলার বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করছে। বুঝুন এবার, দেশে শিল্পকলা বোদ্ধার অভাব নাই!
এবার আসুন আমরা সুপ্রীম কোর্টের সেই গ্রিক ভাস্কর্যটা দেখি।
চারিদিকে শাপলার জলজ আবহাওায় একটি নারীমুর্তি। স্পষ্টতই যা বাঙালি নারী, গ্রিক নয় কোন মতেই। উপস্থাপনা এমন, যেন থেমিস বাঙলার দেবী। এবার আসুন আমরা মুল থেমিস দেবীকে দেখি। নোটের কভার ছবিতেও আছে, তবুও আরেকটা বড় ছবি দিলাম।
আমরা দেখতেই পাচ্ছি, মুল দেবী থেকে সুপ্রীম কোর্টের দেবীর উপস্থাপনা ভিন্ন। এই ভিন্ন উপস্থাপনা দিয়ে তাহলে দেবী থেমিসকে বাঙলার সংস্কৃতিতে আত্মস্থ করার চেষ্টা হয়েছে ন্যায়, বিচার আর আইনের প্রতীক হিসেবে।
যে কোন শিল্পবস্তুর দুইটা গুণ থাকে। একটা মানবিক গুণ, আরেকটা প্ল্যাস্টিক গুণ। বাস্তব জগতে যে ঘটনা দেখে আমার মনে যে ভাবের উদয় হয় শিল্পবস্তু সেই ভাবের কাছাকাছি ভাবের উদয় হলে সেটা মানবিক গুনের কারণে হয়েছে। তাহলে শিল্পবস্তু হিসেবে উত্তীর্ণ হতে হলে থেমিসের ভাস্কর্য দেখে আমাদের মনে একটা ভাবের উদয় হতে হবে।
সুপ্রীম কোর্টের এই পরিবর্তিত থেমিসের ভাস্কর্য যে ভাবের উদয় ঘটাবে, তা নিশ্চিতভাবেই সেই প্রিজামশন বা আগাম অনুমানের উপরে দাড়িয়ে থাকবে যে, আমাদের নিজস্ব কোন ন্যায়, বিচার বা আইনের ইতিহাস নেই। আমাদের বিশ্বাস বা ইমানের কোন মূল্য নাই; যা এই কোটি কোটি মানুষের কাছে আইন, নীতিনৈতিকতা ও সামাজিক বিধিবিধান উৎপত্তির ক্ষেত্র ও মানদন্ড হতে পারে। গ্রিক দেবিই আমাদের একমাত্র আরাধ্য। ন্যায় বা আইনের পশ্চিমা ধারণা এটাই একমাত্র সহি, আমরা সেটাকে অনুকরণ করতে পারি মাত্র। পশ্চিমা ন্যায়, আইন ও বিচারের সেই চিন্তা আর ঐতিহ্যকে কেবল আমাদের মাপে কেটেছেটে নেয়াটাই আমাদের কাজ। এই অনুমান ছাড়া এই ভাস্কর্যের আর কোন বার্তা নেই। আসলে এই ধারণা শুধু কলোনিয়াল ভাবাদর্শ বললে কম করে বলা হবে। এটা শুধু কলোনিয়াল নয়, এটা আপন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতি চরম অপমান।
হেফাজত এই ভাস্কর্যকে প্রত্যাখ্যান করে ও প্রতিবাদ জানিয়ে আমাদের চাবুক মেরে জাগিয়ে দিয়েছে। সারা দেশে অসংখ্য ভাস্কর্য আছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে হেফাজত কোন সুনির্দিস্ট আপত্তি না তুলে এই একটা বিশেষ ভাস্কর্যের বিষয়ে আপত্তি তুলে আমাদের অশেষ উপকার করেছে। তাদের আপত্তি বিচার বিভাগেরও আমলে নেয়া উচিৎ।
না, আপনাকে কোন ইসলামি ধর্মতত্ত্বের জায়গা থেকে ভাবতে হবে না। আপনি জাতিবাদী আর ধর্ম নিরপেক্ষ জায়গা থেকেই ভাবুন। নিজেদের আর কতো নীচে নামাবেন। আর কতো হীনমন্যতায় ভুগবেন।
সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনের জন্য একটি উপযুক্ত ভাস্কর্য বানাতে পারলেন না? আফসোস!!
এই ভাস্কর্য প্রত্যাখ্যান করে হেফাজত অন্যায়টা কী করলো। যেই প্রশ্নটা রাজনীতি আর ইতিহাসের জমিনে দাড়িয়ে লিবারেল স্যেকুলারদের তোলার কথা ছিল সেই প্রশ্নটাই হেফাজত তুলেছে তাঁদের আকিদার জমিন থেকে।
এবার নাহয় আপনারা উত্তর দিন।