আল্লামা ইকবালের লেখা একটা উর্দু কবিতার অনুবাদ জহির রায়হান ব্যবহার করেন তাঁর “জীবন থেকে নেয়া” ছবিতে। সিনেমায় একটা দৃশ্যে শ্রমিকদের ধর্মঘটে আনোয়ার হোসেন আর রাজ্জাক এই গানটা গাইছেন এমন দেখা যায়। পুরো গানটি এইরকম,
“দুনিয়ার যত গরীব কে আজ জাগিয়ে দাও
ওমরাহদের সিংহদ্বারের ভিত্তি কাঁপিয়ে দাও।
শ্রমিকের মনে আগুন জ্বালাও কঠিন আত্মবিশ্বাসে।।
ছোট পাখিদের ঈগলের সাথে যুদ্ধে লড়িয়ে দাও।
জনতাই হবে দেশের মালিক ওই আসে সেই জমানা।।
ঘুনেধরা যত পুরনো বিধান আজকে মিটিয়ে দাও।
যে দেশের বুকে পায় না চাষীরা পেটের ক্ষুধার অন্ন।।
সে দেশের প্রতি শস্য কণায় আগুন লাগিয়ে দাও।
আমার এই মন পায় না শান্তি শ্বেত পাথরের মহলে।।
আমার জন্য মাটির একটি কুটির বানিয়ে দাও”
গানটা দুর্দান্ত কিন্তু যখনই শুনতাম “আমার এই মন পায় না শান্তি শ্বেত পাথরের মহলে।। আমার জন্য মাটির একটি কুটির বানিয়ে দাও”, তখন ঠিক মিলাতে পারতাম না। শ্রমিকেরা তো শ্বেত পাথরের মহলে থাকেনা, সে তো মাটির কুটিরে বা বস্তিতে থাকে। তাহলে সে কেন বলছে “আমার এই মন পায় না শান্তি শ্বেত পাথরের মহলে।। আমার জন্য মাটির একটি কুটির বানিয়ে দাও।“
এই ধাঁধা মিটলো কালকে। এবং বুঝলাম গানটা যতই ভালো হোক। যতই প্রেরনাদায়ী হোক, সিনেমায় ঠিক সুপ্রযুক্ত হয়নি। জীবন থেকে নেয়া আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনে এই ছবির ভুমিকা অনস্বীকার্য। তবুও এই গানটি সুপ্রযুক্ত না হওয়া ছবিটির একটি ত্রুটি বলেই আমার মনে হয়। এবার আসুন দেখি গানটা কোথায় থেকে এলো এবং কেন আমি বলছি গানটা সুপ্রযুক্ত হয়নি।
আল্লামা ইকবালই প্রথম ভারতবর্ষীয় কবি যিনি প্রথম কবিতা লিখে রুশ বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তিনি এই কাজ করতে গিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক তিনটা কবিতা লেখেন।
প্রথম কবিতার শিরোনাম “খোদা কি হুজুর মে লেনিন” মানে “খোদার সামনে লেনিন”। সেই কবিতায় লেনিন খোদার সামনে দাড়িয়ে বর্ণনা দিচ্ছেন পৃথিবীতে কী অনাচার, শোষণ। আর রুশ বিপ্লব করে লেনিন কীভাবে সেই শোষণের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।
দ্বিতীয় কবিতার নাম “ নাওয়ায়ে ফিরিশতা” মানে “ফেরেশতাদের গান”। সেখানে লেনিনের সাথে কথা বলার পর খোদা ফেরেশতাদের পৃথিবীতে এসে দেখে যেতে বলেন। খোদা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ফেরেশতারা পৃথিবীতে এসে শোষণ আর অনাচারের যেই অবর্ণনীয় চিত্র দেখে যান সেটার বর্ণনা করছেন খোদার কাছে। খোদা পৃথিবীর জুলুমের খবর ফেরেশতাদের মুখে শোনার পর তৃতীয় শেষ কবিতার পটভুমি তৈরি হয়।
শেষ কবিতা “খোদা কি ফরমান ফিরিশতে কি লিয়ে” মানে “ফেরেশতাদের জন্য খোদার ফরমান”। এই কবিতাটাই সেই গান “দুনিয়ার যত গরীব কে আজ জাগিয়ে দাও “। এটা খোদার ফরমান, খোদা বলছেন ফেরেশতাদের। তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন ফেরেশতাদের, আমার নিপীড়িত বান্দাদের জাগিয়ে দাও। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমকে খোদা বিপ্লবের নির্দেশ দিচ্ছেন। খোদা তাঁর পেয়ারের বান্দার দারিদ্রে পীড়িত তাই খোদা বলছেন “আমার এই মন পায় না শান্তি শ্বেত পাথরের মহলে।। আমার জন্য মাটির একটি কুটির বানিয়ে দাও”। খোদার তো শ্বেত পাথরের মসজিদে মন শান্ত হচ্ছেনা, খোদা চান মাটির কুটির; খোদা তো তাঁর দুঃখী বান্দার সাথেই থাকতে চাইবেন। এই গানটি কি শ্রমিকদের গলায় সুপ্রযুক্ত হয়েছে?
গানটি শুনুন এই লিঙ্কে।
2 thoughts on ““দুনিয়ার যত গরীব কে আজ জাগিয়ে দাও” গানটির সুলুক সন্ধান”
ভাল লাগল সুলেখাটি পড়ে যার পটভূমি অন্য রকম। জোড়াতালি দিয়াই আমাদের আজ পর্যন্ত চলছে! মিল্লে তো মিলছেই না মিল্লে হোগাতো ছিড়ছে, যুক্তি এইটা। দুখিঃত। বিনোদনের বাহন গুলির সৃষ্টিশিল ধারা গুলি অভ্যাহত রাখতে পারলে হয়তো আমরা আরো ভাল কিছু পেতাম।
এটা তো গীতিকার তার নিজের কথা বলেছেন বলে মনে হচ্ছে। তার মন পায়না শান্তি।