দুনিয়ার ইতিহাস আসলে দাসত্বের ইতিহাস।

যুগ যুগ ধরে মানুষ দাসত্ব করে আসছে: হয় ধর্মতত্ত্বের দাসত্ব অথবা পুঁজির দাসত্ব কিংবা একই সাথে দুটোরই। মধ্যযুগে ধর্মতত্ত্বের দাসত্ব করেছে মানুষ। মধ্য যুগ থেকে অধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে পুঁজির দাসত্বের জোয়াল কাঁধে নিয়ে। আধুনিক যুগে ধর্মতত্ত্বের দাসত্ব কিছুটা লঘু হয়েছে বটে, কিন্তু ধর্মতত্ত্বের চেয়েও বহুগুন শক্তি নিয়ে পুঁজির দাসত্ব মানব প্রজাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে। নতুন এই দাসত্বের ভাবালুতা সৃষ্টির শক্তি পুরানোটার চেয়ে বহুগুন। ধর্মতত্ত্বের দাসত্বে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। মানুষ যে অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে পৃথিবীতে আসে সেই সম্ভাবনার পরম রূপকে সে ঈশ্বর, আল্লাহ, খোদা বলে ডাকে। মানব জনমের সাধনাই হয়ে দাড়ায় সেই পরমের নিকটবর্তী হওয়ার দুর্মর আকাঙ্খা। মানুষের সাথে পরমের যেই ছেদ ঘটে মানুষ সেই ছেদকে অতিক্রম করে যেতে চায় ধর্মের মধ্যে দিয়ে। ধর্মের মধ্যে দিয়ে পরমের অন্বেষণই মানুষের স্ব”ভাব”। এটাই মানুষের হয়ে উঠতে চাওয়ার ইতিহাস। ধর্মতত্ত্ব মানুষকে মানুষের সেই “স্ব”ভাব থেকে চ্যুত করে। মানুষ ধর্ম থেকে চ্যুত হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে ধর্মতত্ত্বের দাসত্ব শুরু করে।

কিন্তু পুঁজির দাসত্বের যুগে সেই মানুষ নিজে হারিয়ে যায় নিজের মধ্যে। নিজেকেই সে ‘ঈশ্বর’ ভাবতে শুরু করে। নিজেকে অমিত সম্ভাবনার আধার ভেবে ‘ব্যক্তি ইচ্ছা’কে উর্দ্ধে তুলে ধরে ‘ব্যক্তি-স্বতন্ত্রতার’ জয়গান গায়। এই সঙ্গীতের মূর্চ্ছণা তাকে এমন এক ভাবালুতায় নিয়ে যায় যে, সে বুঝতেও পারে না, সে আসলে নতুন এক দাসত্বের কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই ভাবালুতার মাত্রা ও পরিধি এতোই ব্যপক যে, এই নতুন অবগাহনে নিজেকে ‍খুজে পাবার সব আকাঙ্খাই তার লুপ্ত হয়ে যায়। পুজি-দাসত্বের ভাবালুতায় নিমজ্জিত এই মানুষ, তার অতীত দাসত্বকে নিয়ে হাসাহাসি করে রোমাঞ্চ অনুভবের স্বর্গ সুখ আস্বাদন করে। তার অতীতের ধর্মতত্ত্বের দাসত্বকেও উপহাস করে। এই দাসত্বের ছিটে ফোটা কারো মধ্যে দেখলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরে। অথচ সে নিজেই বুঝতে পারে না, তার এই নয়া দাসত্বের বন্ধনকে নিয়েও অন্য কেউ উপহাস করতে পারে। আধুনিক কালে পুঁজির দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ এই মানুষগুলো সত্যিই কি তার পুরানো দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করতে পেরেছে? সে দাবি করে ‘পেরেছি’? কী অর্থে পেরেছে? ধর্মতত্ত্বের দাসত্বকে কেবল রাষ্ট্রীয় বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে নিজ ঘরের কোনে ঠাই করে দিয়েছে। এটা ভেবেই সে পূলক অনুভব করে। কিন্তু দাসত্বতো দাসত্বই, তা রাষ্ট্রে হোক কিংবা ঘরের মধ্যেই হোক। সুতরাং এখন একথা প্রকাশ্যে বলার সুযোগ এসেছে যে, তোমরা কোন দাসত্ব থেকেই মুক্ত হতে পারোনি। দুটো দাসত্বেই এখন তোমরা আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা।

আরেক দল আছে, যাদের অন্তর থেকেই ধর্মতত্ত্বের দাসত্বের মুক্তি ঘটেছে বলে তারা মনে করে, কিন্তু বাস্তবে পুজির দাসত্বের জোয়ালকে তারা শক্তভাবে নিজ কাঁধে বেধে নেয়। ধর্মতত্ত্বের দাসত্বের উপহাসই এদের একমাত্র ‘উপাসনা’র বস্তু।

মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি, আসলে সব ধরণের দাসত্ব থেকে ‍মুক্তি। এই মুক্তির জন্য দরকার চিন্তার লড়াই, তৎপরতার লড়াই। চিন্তা ও তৎপরতাই কেবল সব ধরণের দাসত্ব থেকে মানব সমাজকে মুক্ত করতে পারে। মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ সৃষ্টির পথে এগিয়ে দিতে পারে। চিন্তা আর তৎপরতার নিশানা আধুনিক যুগে একজন মানুষই দেখাতে পেরেছিলেন তাঁর নাম ছিল কার্ল মার্ক্স।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter