শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগের হামলায় ঘটনায় জাফর ইকবালের ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রথমে অভিযোগ থেকে অনুযোগ সেটা থেকে অনুরাগে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনাটিকে জাফর ইকাবালের প্রবল সমর্থকেরা দেখাতে চান পুত্রবৎ ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের পিতাসুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলেই। এই উপস্থাপনাটা চমৎকার আর বাৎসল্য কথাটা মনোহর। শিক্ষক পিতা আর ছাত্র পুত্র এমন মনোহর তুলনায় আমাদের হৃদয় আদ্র হয়ে আসে। তাই এমন তুলনার সামনে আমরা সততই বিহবল হয়ে পড়ি।
পরিবার এবং আত্মীয় আমাদের “অহং” এর বর্ধিত রুপ। স্বামী স্ত্রী যেমন পরপস্পরের অর্ধাঙ্গ তেমনি পুত্র পিতার প্রলম্বন, তাই পরিবার “আমি” র পরিবর্ধিত সংস্করন। আমি যখন পুত্রকে ক্ষমা করি তখন আমি নিজেকেই ক্ষমা করি, আমার অহং কে ক্ষমা করি, আমি আমার আমিত্বের বর্ধিত রূপকে নিজের ক্ষমা দিয়ে আর মহিয়ান করে তুলি। পরিবারের বন্ধনের মুল আবেগ প্রেম। পরিবারের এই জগতে পরস্পরের সদ্ভাবের জন্য যুক্তির প্রয়োজন নেই।
মানুষ যখন আরো বৃহত্তর সংগঠন ও সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় তখন তাঁকে এমন মানুষের সঙ্গে জুক্ত হতে হয় যাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, রুচির মিল নেই। এই ভিন্ন জগতের সাথে অহং এর কোন সম্পর্ক নেই। এই ভিন্ন জগতের সাথে মোকাবেলায় পরিবারে অনুসরনীয় নীতিবোধ চলেনা। এই জগতের অন্য স্বতন্ত্রের সঙ্গে আমরা যুক্ত হই যুক্তি ও ন্যায়ের উপর। এভাবেই বৃহত্তর সমাজে পারস্পরিক কর্তব্য আর ও অধিকারের ভিত্তি তৈরি হয়।
অম্লান দত্ত এই প্রসঙ্গেই “স্বজন ও সজ্জন” প্রবন্ধে লিখেছেন,
“আধুনিক জীবনের সাধারণ কাজকর্মে যে নীতিবোধ প্রয়োজন হয় তাতে অনেক সময় প্রেমের অংশটা প্রধান নয়, তাঁকে প্রাধান্য দেওয়া বিপদজনক। পরীক্ষার খাতা দেখার সময় পরীক্ষক যে নীতিবোধ থেকে নিরপেক্ষতা রক্ষা করেন তাতে সাধারণ অর্থে প্রেম অনুপস্থিত; তার পরিবর্তে আছে ন্যায় ও মঙ্গলবোধ।”
পরিবারের সদস্য হিসেবে পারিবারিক কর্তব্য চলে প্রেমে আর সমাজের সদস্য হিসেবে পাবলিক ডিউটি বা সামাজিক কর্তব্য চলে ন্যায় ও মঙ্গলবোধ থেকে। অম্লান দত্ত প্রেম ও নিয়ম প্রবন্ধে ঠিক এই প্রসঙ্গেই বলেছেন,
”সমাজ যতই বৃহৎ ও জটিল হয়, ততই একমাত্র প্রেম অথবা আত্মীয়তাবোধের দ্বারা সামাজিক সংহতি রক্ষা করা কঠিন, এমনকি অসম্ভব হয়ে ওঠে। কল্যাণ বুদ্ধিকে তখন যুক্তির সাহায্যে রুপায়িত করতে হয় নিয়মের ভিতর। নিয়মই ন্যায়ের ভিত্তি। শুধু প্রেমের উপর ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করা যায়না; কারণ প্রেম চঞ্চল, প্রেম নিরপেক্ষ নয়, প্রেম বিচারে অপটু।”
জাফর ইকবাল সমাজকে চালাতে চেয়েছেন পারিবারিক জীবনের নীতিবোধ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছেন প্রেমের মাধ্যমে; সেই প্রেম চঞ্চল, সেই প্রেম নিরপেক্ষ নয়, সেই প্রেম বিচারে অপটু। তাই উনার পিতৃসুলভ বাৎসল্য সমাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সমাজ ও পরিবারের নীতিবোধের এই মৌলিক তফাতের বিষয়টি উনি জানেন না সেটা মেনে নেয়া আমার জন্য কষ্টকর। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি তিনি বাৎসল্যের কপট ছুরি দিয়ে সমাজের ন্যায় ও মঙ্গলবোধকে হত্যা করেছেন।