গতকাল চারুমামা এসেছিলেন। চারুমামা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ক্যান্টিনের মালিক। আমাদের তারুণ্যের সঙ্গি। চারু মামা খুব অসুস্থ। বছর দশেক আগে ক্যান্সার হয়েছিল। সেরে উঠেছেন। এবার তীব্র সিওপিডি। দুই পা হাটলেই হাঁপাতে থাকেন। চারু মামাকে দারিদ্র ছাড়েনি। ক্যান্টিনটাকে টেনে টুনে চালিয়েছেন। সবচেয়ে লজ্জার বিষয় এখনকার অনেক প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক চারু মামার কাছে নেয়া ছাত্র অবস্থার বাকী শোধ করেননি। আমি চারুমামার কাছে কাল আমার চেনা সেরা দশ ডিফল্টারের নাম জানতে চাইলাম। হিসাব করে দেখলাম সকলেই প্রতিষ্ঠিত। এবং সবচেয়ে বেশী বাকি খেয়ে টাকা না দেয়া মানুষটি অ্যামেরিকায় থাকে (ভাগ্যিস সে আমার বন্ধু তালিকায় নেই)।
চারু মামা কেন জানি ক্যান্টিনের ভাড়া আর বিদ্যুৎ বিল দিতে চাইতেন না। এই প্রসঙ্গ আসলেই তিনি কাঁচুমাচু করে এমন একটা হাসি দিতেন যে উনার এই সামান্য অপরাধের অধিকার আছে বলেই মেনে নিতে ইচ্ছে করে।
আমি তখন রাজশাহী মেডিক্যালের জি এস। তখন গরম কাল চলছে। দুপুরে ক্যান্টিনে গেছি দেখি ফ্যান চলছে না। চারু মামাকে জিজ্ঞেস করতেই উনি একগাল হেসে বললেন, আপনার প্রিন্সিপ্যাল লাইন কেটে দিয়েছে। বিল বাকী ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম কত টাকা? চারু মামা বিগলিত হাসি দিয়ে বললেন বেশী না ছত্রিশ হাজার টাকা। বেশী না? আমরা সেই সময় মাস চালাতাম ১ হাজার টাকায়। যাই হোক, আমি তখন মেডিক্যাল কলেজের স্বীকৃত “রাজা” 😀 । বলে দিলাম কাটা লাইনটা প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টে জুড়ে দিতে। মহা উৎসাহে কাজ চলল। কিছুক্ষণ পরেই আলো জ্বলে উঠলো, ফ্যান চলল।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শমন আসলো প্রিন্সিপ্যালের অফিস থেকে। চারু মামা লুঙ্গি ঝাকাতে ঝাকাতে বুক ফুলিয়ে হাজিরা দিতে গেলেন। একটু পরে আমাকে ডাকতে আসলো। আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি প্রিন্সিপ্যাল অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন আর চারুমামা নিরুত্তাপ মিটমিট করে হেসে চলছেন। আমার দিকে তাকিয়ে প্রিন্সিপ্যাল হুঙ্কার ছাড়লেন, কোন অধিকারে প্যাথলজি থেকে বিদ্যুৎ লাইন দিয়েছ? এখনই বলছি কেটে দিতে।
আমি বললাম, স্যার, ছাত্রদের ক্যান্টিনের বিদ্যুতের লাইন কাটবেন, ছাত্রদের জানাবেন না একবার? ফয়সালা নিশ্চয় একটা করে যেতো, আপনি তো তুঘলকি করে লাইন কেটে দিয়েছেন। নিজে তো এসির মধ্যে বসে আছেন। আর এই গরমে ছাত্রদের ক্যান্টিনে ফ্যান চলেনা। এটা কেমন বিচার আপনার? আপনি না ছাত্রদের অভিভাবক? ওই লাইন যেভাবে দেয়া হয়েছে সেভাবেই থাকবে; কেটে দিলে আপনার ঘরের এ সি খুলে নিয়ে যাবো।
সেই লাইন আর কাটেনি। চারু মামাকেও আর কখনো বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়নি। ক্যান্টিনের ভাড়া নিয়ে আরেক বিশাল ঘটনা। সেই জটিলতা বেশ মজা করেই ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধাণমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ফয়সালা হয়েছিল। সেই সময়ের দশ বছর আগেই আমরা ডাক্তার হয়ে গেছি। তবুও প্রাক্তন ছাত্ররা এই সমস্যার সমাধানে মিলেনিয়াম পুনর্মিলনীতে প্রধান অতিথি হয়ে আসা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই একটা ফয়সালা করে দিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
লেখাটির ফেইসবুক ভার্সন পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন