সম্প্রতি বাম ও গণতান্ত্রিক জোটের এক সংবাদ সন্মেলনে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম অভিযোগের আঙ্গুল ডঃ কামাল হোসেনের দিকে তুলে বলেছেন, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া আন্দোলনের ফল বিএনপির ঘরে তুলে দিতে চায়, তাই তারা সেখানে যোগ দিবেন না।
আমার বিনীত প্রশ্ন, এই ঈপ্সিত আন্দোলন কীসের জন্য? আন্দোলন কি, নির্দিষ্ট করে কারো ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্য থেকে পরিকল্পনা করে করা হচ্ছে? নাকি চলমান ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে, জনগনের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত করে একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে পরিচালিত হচ্ছে?
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই আন্দোলনে বাম ও গণতান্ত্রিক জোটের এবং ডঃ কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার দাবী প্রায় অভিন্ন। এমনকি বিএনপি, জামায়াত ও চরমোনাইয়ের পীরের দলও একই দাবীই তুলছে! এই দাবীসমূহ পূরণ হলে আন্দোলনের ফসল পাবে দেশের সাধারণ মানুষ। জনগনের ভোটাধিকার ফিরে আসবে। তারপর জনগণ কাকে ভোট দেবে, সেটা তাদের ইচ্ছা বা পছন্দের বিষয়। এই মৌলিক অধিকারটাই দেশবাসী হারিয়ে ফেলেছে। লুট হয়ে যাওয়া তেমন অধিকারগুলো আদায়ের জন্য আজ এই গণতন্ত্রের আন্দোলন জরুরী হয়ে পড়েছে।
দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরেপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি বিজয়ী হবে, এটা অতি সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। তেমন বিজয় কারো কাছে অপছন্দনীয় হতেই পারে। তাই বলে এই মৌলিক বা প্রাথমিক অধিকারটি অর্জনের লড়াইয়ে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়া যাবে না, সকলে মিলে একসাথে দাঁড়াতে পারবো না; এটা কোন তত্ত্ব! এটা কি গণতন্ত্রের রাজনীতি, শ্রেণী সংগ্রামের কৌশল না সীমাহীন ভুলের সাগরে আত্মহনন?
ভোটের অধিকার হরণ করেছে যে স্বৈরশাসক, তার বিরুদ্ধে একযোগে না দাঁড়ালে এই স্বৈরশাসককেই প্রকারান্তরে যে সহায়তা করা হয়, তা কি জনগণ বুঝতে পারবে না? এদেশে বাম ও কমিউনিস্টদের একটি অংশ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, এটা ‘দুই কুকুরের কামড়া- কামড়ি’ এমন তত্ত্ব দিয়ে! এমনকি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক মাস আগে পর্যন্ত আরেক পক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিলো। তারাই পচাত্তরে বাকশাল-এ বিলীন হয়েছিলো। তাদের বিবেচনায় ‘বিপ্লবী মুজিব’কে দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের লোভে! সিপিবি জেনারেল এরশাদের ১৯৮৬ র নির্বাচনে অংশ নিয়ে স্বৈরাচারী শাসনকে দীর্ঘায়িত করেছিল! আজ ২০১৮-তে এসে ‘আপদ আর বিপদ’ এই কবিরাজী তত্ত্ব দাঁড় করে কি, পঁচাত্তর পরবর্তী সবচেয়ে কঠিন, নির্মম ও লুটেরা স্বৈরচারের দুঃশাসনকেই দীর্ঘায়িত করার ভুল পথ অনুসরণ করা হচ্ছে না?
পাঁচ দফা দাবিতে একমঞ্চে থেকে আগামী দিনে আন্দোলন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, যুক্তফ্রন্ট ও বিএনপি। ব্যাপক জনপ্রিয় এই দাবীসমূহ মানাতে শেখ হাসিনার সরকারকে বাধ্য করতে হবে। যে সকল রাজনৈতিক দল মনে করে এগুলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত; তাহলে তাদের এককাতারে দাঁড়াতে অসুবিধা কোথায়?
চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবীগুলো পূরণ হলে, সবার জন্য অভিন্ন লেভেল প্লেয়িং গ্রাউণ্ডে দাঁড়িয়ে ‘বাম ও গণতান্ত্রিক জোট’ এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিক। বিএনপি বা ডঃ কামাল হোসেন বা ডাঃ বি চৌধুরীর সাথে মিলে অভিন্ন প্রতীকে ভোটযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে কেউ কি তাদেরকে বলছে বা বাধ্য করবে! চলমান অপশাসনের অবসানের হলে তারা আলাদা ভাবে আপন শক্তির উপর দাঁড়িয়ে নির্বাচন করবেন, অসুবিধা কোথায়?
সকলের সাথে মিলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরেপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে আন্দোলনও করবেন না, আবার নির্বাচন ফেয়ার হবে না বলে ভোটও করবেন না, এটা কেমন নীতি?
বিপ্লবী রাজনীতিতে লক্ষ্য অর্জনের নীতিভ্রষ্ট না হয়ে নানান সময়, বিভিন্ন ধরণের ঐক্য ও সমঝোতা করে এগুতে হয়। বর্তমান আওয়ামী সরকার তার নীপিড়নের সকল উপাদান নিয়ে এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে নূন্যতম কর্মসূচির ভিত্তিতে, তার বিরুদ্ধে জনগনের ব্যাপক ঐক্য গড়ে তোলা জরুরী। নানা মত ও নানান পথের শক্তির মধ্যকার এমন মহাজোট, বিভিন্ন সময় বামপন্থীরাই উদ্যোগ নিয়ে গড়ে তুলেছে। ভাবতে অবাক লাগে, তারাই আজ এমন মহামিলনের পথে বাধ সাধছে!
মানসিক এই বাধা অতিক্রম করুন। আওয়ামী লীগের প্রতি শেষ মোহটুকুর রেশ না কাটলে, এই বামপন্থীরা ছদ্মবেশী আওয়ামী লীগ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরো মুমূর্ষু হয়ে পড়বে।
‘কোটা সংস্কার’ এবং নিরাপদ সড়কের দাবীতে গড়ে ওঠা স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের বৈশিষ্ঠগুলো স্মরণ করুন। সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস না উঠলে, প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠা এই অসহায় তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী রাজপথে নেমে আসতো না! দেশবাসী নেতৃত্বহীন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ভেতর এখনো ‘বাম ও গণতান্ত্রিক’দের প্রতি কিছু আস্থা অবশিষ্ট আছে, সেটা বাড়িয়ে তুলতে হলে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’য় তাদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। তা না পারল, ইতিহাস এদেরকে ক্ষমা করবে না।
নিজেদেরকে আলাদা রাখাটা কোন অর্থেই ‘বাম ও গণতান্ত্রিক’দের লড়াইকে সাহায্য করবে না। এটা জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াবে, এমন নীতি শুধু মাত্র ফ্যাসিস্টদের টিকে থাকাকে সহায়তা করবে! পবিত্র ও নির্ভেজাল থাকার এমন ভুল কৌশল দেশ ও জনগণের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং এর অনুসারীদের জন্য তা আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
আশা করবো, আমার সাবেক দল সিপিবি ও তার মিত্ররা অতীতের মতো আবারো এক ঐতিহাসিক ভুল করে, তার ইতিহাস নির্ধারিত কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবেনা।
জনগনের আকাঙ্ক্ষার পাশে দাঁড়ান, কারণ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম আবারো অবশ্যই বিজয়ী হবে।