“মানুষকে তার স্বাভাবিক ইচ্ছাকে দমন করে, সামাজিক নিয়ম পালন করার মাধ্যমে স্থিতিশীল সমাজ তৈরি করতে হয়” ১৯০৮-২০০৯

বেলজিয়ামে জন্ম নেয়া নৃতত্ববিদ, লেভি- স্ট্রস নৃতত্ত্বকে স্ট্রাকচার দিয়ে ব্যাখ্যা করার  জন্য বিখ্যাত। স্যাসুর, মিথ বা কল্পকথা ব্যাখ্যার যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন লেভি স্ট্রস সেভাবেই নৃতত্ত্বর স্ট্রাকচার অনুসন্ধান করেছেন। The Raw and the Cooked and The Elementary Structures of Kinship তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ। প্যারিসে বেড়ে ওঠা লেভি স্ট্রস প্রথম জীবনে সিমন দ্য বোভয়া এবং সার্তের সাথে সাথে দর্শনের বিষয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ব্রাজিলে সমাজবিদ্যা এবং নৃতত্ত্ব পড়তে যান। দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি তাঁকে তাঁর উদ্ভাবিত কল্পকথা বা মিথের স্ট্রাকচারিস্ট থিসিস তৈরিতে সাহায্য করে।

স্যাসুর যেভাবে ভাষাকে langue’ এবং ‘parole’ এই দুই ভাগে ভাগ করে ভাষাতত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছিলেন সেই ধারনাকে ব্যবহার করে লেভি স্ট্রস বিভিন্ন সংস্কৃতির কল্পকথাকে ব্যাখ্যা করেছেন। langue’  একটি ফরাসি শব্দ যার অর্থ ল্যাঙ্গুয়েজ এবং ফরাসী ভাষায় ‘parole’ মানে “বাক” বা “বাচন”। স্যাসুর বলেন, ল্যাঙ্গুয়েজ বিমূর্ত, যা স্বতন্ত্র নিয়ম ব্যবহার করে ‘parole’ মানে “বাক” বা “বাচন” যা ল্যাঙ্গুয়েজকে অর্থমুলক শব্দে রুপান্তর করে। একই ভাবে লেভি স্ট্রস বুঝতে পারেন কল্পকাহিনীর বিষয়বস্তু লিঙ্গুইস্টিকের “বাক” বা “বাচনের” মতো, এবং কল্পকথার বিষয়বস্তু দিয়ে তার স্ট্রাকচার ব্যাখ্যা করা যায়না। বিভিন্ন সংস্কৃতির কল্পকথার বিষয়বস্তু ভিন্ন হলেও তাদের স্ট্রাকচার সার্বজনীন এবং অভিন্ন। ক্লদ লেভি স্ট্রস সারাজীবন কাজ করেছেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে প্রচলিত পৌরাণিক মিথ, লোকজ গল্পগাথা, যুগের পর যুগ চলে আসা নির্দিষ্ট অভ্যাস অথবা ভঙ্গী নিয়ে। প্রায় তিন দশক ধরে আমাজনের ইন্ডিয়ানদের জীবনাচরন ব্যাখা বিশ্লেষন করে দুনিয়ার যাবতীয় পৌরানিক কাহিনীগুলোর মধ্যে একটা সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। পৌরানিক মিথ ও প্রথার মৌলিক ধারনাকে তিনি বিশ্লেষন করে আবিস্কার করেছেন তার অন্তর্নিহিত বিন্যাস, তার অভ্যন্তরীন প্যাটার্ণ। লোকজ স্থানীয় মিথ নিয়ে কাজ করার সময় ক্লদ লেভি স্ট্রসের মিথলজি হয়ে যায় মিথলজিক। যুক্তি দিয়ে বোঝা লোককল্প। ফলে নির্দ্বিধায় তিনি দাবী করেন আদিম সমাজ নিয়ে তার তাত্ত্বিক অবস্থান- আদিবাসী মানুষের মানস বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত ভাবেই পশ্চিমা সভ্যতার মানসের সমকক্ষ। যে কোন জাতিসত্ত্বার নিজস্ব চিন্তা সংস্কৃতি ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে যে ভাবনা প্রকাশ করে, পশ্চিমা যে কোন ভাবনার চেয়ে তা কোন অংশে কম নয়।

লেভি স্ট্রস মিথের উদ্ভব ও বিবর্তনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখান যে কল্পকাহিনী গুলোর বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট যাই হোক না কেন তার উদ্ভব ও বিবর্তন একটি অভিন্ন স্ট্রাকচারের ধারাবাহিক অ্যাডাপটেশন। লেভি স্ট্রসের আগে সমাজতত্ত্ববিদ বা মনোবিদদের ধারনা ছিল যে কল্পকথা গুলো এক নিরন্তর অর্থবহ গল্প যেগুলোর মর্মার্থ কোন একটা আদি গল্পের ভেতরে প্রোথিত আছে। কিন্তু লেভি স্ট্রস দেখান যে কল্পকথার বিষয়বস্তুর মর্মার্থ একটা মিথ থেকে আরেকটা মিথে রুপান্তরের মধ্যেই নিহিত। সেকারনেই লেভি স্ট্রস বলেন কোন একটি কল্পকথার মুল পরিচয় লুকিয়ে আছে তার বিভিন্ন রুপান্তরিত সংস্করণের মধ্যে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি দাবী করেন যে, মানব সভ্যতা তার সার্বজনীন সমস্যাবলীকে কল্পকথার স্ট্রাকচারের মাধ্যমে রুপকায়িত করেছে। তিনি দক্ষিন আমেরিকার এক ধরণের কল্পকথা আছে যেগুলিতে রান্না সংক্রান্ত থিম ব্যবহার করা হয়েছে যা দিয়ে প্রকৃতি থেকে সভ্যতায় রুপান্তরকে কাঁচা খাবার থেকে রান্না করা খাবারের রুপকের মাধ্যমে মূর্ত করা হয়েছে। আরেক ধরণের কল্পকথায় পোশাক এবং পরিচ্ছদের রুপক ব্যবহার করা হয়েছে যা দিয়ে নগ্নতা মানে অনগ্রসরতা আর আচ্ছাদিত শরীর মানে সভ্যতার অগ্রসর হওয়াকে বোঝানো হয়েছে; আরেক ধরণের কল্পকথায় নারীকে প্রকৃতি আর পুরুষকে সভ্যতা হিসেবে দেখানো হয়। লেভি স্ট্রস এইভাবে কল্পকথার স্ট্রাকচারে একাধিক বিপরীতার্থক শব্দ সনাক্ত করেছেন যা মানব মনের বিকাশে সার্বজনীন দ্বৈত চিন্তাকে রুপকায়িত করেছে যেমন রান্না-কাচা, নগ্ন- পোশাক আচ্ছাদিত, পুরুষ-নারী ইত্যাদি।

উদাহরন হিসেবে লেভি স্ট্রস ইডিপাসের কল্পকথার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন, যেখানে ইডিপাস না জেনেই নিজের পিতাকে হত্যা করে এবং রাজা হবার জন্য নিজের মাকে বিয়ে করে। ফ্রয়েড তার সাইকো এনালাইসিসে এই কল্পকথা ব্যপকভাবে ব্যবহার করেছেন। লেভি স্ট্রস বলেন, ফ্রয়েড যেভাবে এই কল্পকথার ব্যাখ্যা করছেন তা ইডিপাসের কল্পকথার পুনর্নির্মাণ, এবং ফ্রয়েডের এই পুনর্নির্মিত কল্পকথাও পুরো গল্পটার অংশ। তার মতে এই পুনর্নির্মাণ প্রকৃতি আর সভ্যতার দ্বৈততা প্রকাশের আরেক পথ। মানুষকে তার স্বাভাবিক ইচ্ছাকে দমন করে, সামাজিক নিয়ম পালন করার মাধ্যমে স্থিতিশীল সমাজ তৈরি করতে হয়।

পরিশেষে তিনি তার বিশ্লেষণ থেকে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ল্যাঙ্গুয়েজ, মানব অভিজ্ঞতার কিছু দ্বৈত উপাদান কে এনকোড করে। লেভি স্ট্রসের চিন্তা একটি মৌলিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হওয়ার কথা যা দিয়ে বোঝা যেত কীভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতি তাদের সমস্যাকে এনকোড করে এবং তাদের মৌলিক গঠন বা স্ট্রাকচারকে এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে প্রকাশিত করে। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বস্তু/বিষয়, মন/পদার্থ এই সংক্রান্ত ধারনার পশ্চিমা দ্বৈতবাদ বা ওয়েস্টার্ন ডুয়ালিজম দক্ষিণ আমেরিকার সেই কাচা এবং রান্নার মতো কল্পকাহিনী বা মিথের আরেকটা সংস্করণ; যেটা কোন গুরুত্বপূর্ণ মেটাফিজিকাল ক্যটেগরিও নয় আবার নৃতাত্ত্বিক উৎসাহের লক্ষ্যও নয়। এই ধারনাগুলো দ্বৈততা বা ডুয়ালিজমকে যেভাবে চিত্রিত করে তা ব্যাক্তির আভ্যন্তরীণ, পরিবেশের সাথে ব্যাক্তির নয়। লেভি স্ট্রসের জন্য আমরা যখন স্ট্রাকচার এবং পারস্পরিক সম্পর্ক বা রিলেশনের স্তরে নেমে আসি তখন আর কী অবশিষ্ট থাকে, অবশিষ্ট থাকে একটি ভৌত পরিবেশে একটি জীবের কাজ এবং ভাষা। কীভাবে মানুষ পরিবেশ থেকে সেন্স অরগ্যান দিয়ে তথ্য প্রেরন করে; কল্পকথা বা মিথ রুপান্তরিত হয় মানুষের শরীর সম্পর্কে সেই স্ট্রাকচারাল ফ্যাক্টে। লেভি স্ট্রস সেকারনেই দাবী করেন তাঁর চিন্তা হিউম্যান অ্যাক্টিভিটির বিজ্ঞান সম্পর্কে একটা স্পষ্ট পথ বাতলে দেয়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter