অমর্ত্য সেন তার নোবেল পুরষ্কারের টাকা দিয়ে ১৯৯৯ সালে প্রতীচী ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন; শিক্ষা নিয়ে কাজ করার জন্য। একইসাথে ভারত প্রতীচী ট্রাষ্ট আর বাংলাদেশ প্রতীচী ট্রাষ্ট এই দুইটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। ভারত ট্রাস্টে আছেন অমর্ত্য সেন, দিপঙ্কর ঘোষ ও সভাপতি হিসেবে আছেন অমর্ত্য সেনের মেয়ে অন্তরা দেব সেন। বাংলাদেশ পার্টে আছেন সভাপতি হিসেবে রেহমান সোবাহান, কামাল হোসেন, ফজলে হাসান আবেদ, সুলতানা কামাল আর মেঘনা গুহ ঠাকুরতা।
প্রতিষ্ঠানটার পরিচিতি দেয়া দরকার ছিলো। কারণ তাঁরা সকলেই বাংলাদেশের সো কল্ড প্রগতিশীল ও স্যেকুলারদের কাছে খুব গ্রহনযোগ্য। তারা পশ্চিমবঙ্গে খুব ভালো কিছু কাজ করছে বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণা ও পর্যালোচনার কাজটা। শিশু শিক্ষা নিয়ে তারা পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকবছর ধরে একটা গবেষণা করে। তার ফলাফলটা খুব ইন্টারেস্টিং। ফলাফলটা জানার আগে, পশ্চিমবঙ্গে “শিশু শিক্ষা কেন্দ্র” বলে একটা জিনিস আছে সেটা জেনে নেয়া ভালো। কোন লোকালয়ের এক কিলোমিটারের মধ্যে যদি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকে তাহলে সেখানে একটা “শিশু শিক্ষা কেন্দ্র” খোলা হয়। এটা আমাদের দেশের মক্তব বা পাঠশালার মতো কমিউনিটি এডুকেশন সেন্টার। শিক্ষকদের বেতন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের দশভাগের একভাগ। তারমানে অতি অল্প বা নামমাত্র খরচে এই কেন্দ্রগুলো চলে। এর শিক্ষকেরা সেই স্বল্প বেতনে কাজ করেন। স্বল্প মানে ১ হাজার রুপি, তাও সেটা তারা নিয়মিত পাননা। এই কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন রুম নেই শিক্ষা উপকরণেরও ঘাটতি আছে। শিক্ষকের বাড়ী, কোন এলাকার মানুষের ব্যবহার করতে দেয়া স্থান বা সামাজিক সমাবেশ যেখানে হয় সেখানেই এই কেন্দ্রগুলো শিক্ষা দেয়া হয়।
কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে শিক্ষার মান, ছাত্রদের উপস্থিতি, শিক্ষকদের উপস্থিতি, অভিভাবকদের সন্তুষ্টি প্রাইমারি স্কুল থেকে এই শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে অনেক বেশী। অবাক বিষয় বটে। দশ গুনের বেশী খরচ করেও নিয়মিত শিক্ষকেরা বেতন পেয়েও, স্কুল ভবন শিক্ষা উপকরণের অভাব না থাকার পরেও কেন প্রাইমারী স্কুলগুলো পারফর্ম করতে পারছেনা শিশু শিক্ষা কেন্দ্রগুলির মতো? কেন এটা হচ্ছে? খুব জটিল প্রশ্ন।
এর কারণ হিসেবে যা যা গবেষকেরা আইডেন্টিফাই করেছেন সেটা হচ্ছে; যারা পাঠ নিতে আসছে তাঁদের সাথে, ও তাঁদের দরিদ্র অভিভাবকদের সাথে, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের একটা শ্রেণীগত ব্যবধান থাকে। শিক্ষকেরা নিজেদের উঁচু শ্রেণীর বলে বিবেচনা করেন। ফলে ছাত্র এবং অভিভাবক শিক্ষকের সাথে কমিউনিকেইট করতে পারে না। শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষকেরা ওই কমিউনিটির সদস্য হওয়ায় কোন শ্রেণীগত তফাৎ থাকেনা আর তাঁদের শিক্ষা বিষয়ে একটা সামাজিক দায় থাকে কমিউনিটির কাছে। শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষকেরা ছাত্র এবং তার পরিবারের সাথে একাত্ম হতে পারেন, এই একাত্ম হওয়াটা গবেষকদের কাছে শিক্ষার বেটার আউটকাম হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ মনে হয়েছে। আর এই একাত্ম হওয়াটা অংশত শিক্ষকের সমাজের প্রতি নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় হিসেবেই তারা চিহ্নিত করেছেন।
সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালিতে অপুর পাঠশালায় আমরা দেখি শিক্ষক মুদিখানার দোকানদারি করেন, আর খালি গায়ে, পিঠ চুলকাতে চুলকাতে আর লবন মাপতে মাপতে ছাত্রদের বলেন, “এই সেই জলস্থান মধ্যবর্তী”, তারপরে আবার এক পয়সার মুড়ি বেচেন, আড্ডা দেন, তামাক খান, ছাত্র পিটান; সবই চলে সেখানে। এই চিত্রটাকে আমরা যতই অনাধুনিক মনে করিনা কেন, আজকের গবেষণায় বলছে; এর কাছাকাছি স্ট্রাকচারের শিক্ষায় আউটকাম আধুনিক স্কুলের চাইতে অনেক ভালো।
কমিউনিটি এডুকেশনের কনসেপ্ট কি বাংলাদেশের স্যেকুলারেরা মানবেন এখন? বাই দ্য ওয়ে, কওমি মাদ্রাসাও কিন্তু কমিউনিটি এডুকেশন; জানেন তো?
(যারা পথের পাঁচালির পাঠশালার সেই দৃশ্যটা দেখতে চান তারা নিম্নে দেয়া ইউটিউবের ক্লিপ দেখুন)
http://www.youtube.com/watch?v=Og_E0uTGjoo