কয়েকদিন আগে ফেইসবুকে ব্লগের একটা লিংকে এনলাইটেনমেন্ট নিয়ে কান্টের একটা লেখার অনুবাদ দেখলাম। যদিও ফজলুল আলম ২০০৮ সালেই বাংলাদেশে এই অনুবাদ ছাপেন। নতুন ব্লগের অনুবাদে অনুবাদক বলেছেন এনলাইটেনমেন্ট নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। এনলাইটেনমেন্ট নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কী আছে সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর একটা বিশেষ সময়কে এজ অফ এনলাইটেনমেন্ট বলে অভিহিত করা হয়। এই সময়টাতেই এনলাইটেনমেন্ট পুঁজিবাদের দার্শনিক ক্ষেত্র তৈরি করে। সেকারণেই এই এনলাইটেনমেন্টকে বুঝা দরকার। কারণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের বামপন্থীরা মুলত প্রগতিশীলতা বলতে এনলাইটেনমেন্টকে বুঝে থাকেন এবং সেটার চর্চা করেন।
এনলাইটেনমেন্ট নিয়ে ক্রিটিক আছে। সেই ক্রিটিক করেছেন খোদ কার্ল মার্ক্স, মিশেল ফুকো ক্রিটিক করেছেন ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের ক্রিটিক্যাল থিঙ্কাররা আর নোয়াম চমস্কি। উনারা কি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন? কান্ট তো এনলাইটেনমেন্টকে ফুল ব্লৌন অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। তাই পরের প্রজন্মের দার্শনিকদের এই ক্রিটিকের দায় নিতে হয়েছে। কান্ট লেখাটা লিখেছিলেন ১৭৮৪ সালে। আর এই এনলাইটেনমেন্টের প্রথম ক্রিটিসিজম হয় মার্ক্সের হাতেই। ইউরোপীয় আধুনিকতা দাড়িয়ে ছিল যার উপরে তার প্রথম এবং সবচয়ে বড় ক্রিটিক মার্কস। যিনি ঐ সভ্যতার খোল নলচে পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সাথে মিলিয়ে গোটা সমাজের ভন্ডামির চেহারাটাকে খুলে দিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে এনলাইটেনমেন্টজাত আধুনিকতাকে লক্ষ্য করে লিখলেন;
“ বুর্জোয়া শ্রেণীর যখনই ক্ষমতা হয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি শোভন সম্পর্ক খতম করে দিয়েছে। যেসব বিচিত্র সম্পর্কে মানুষ বাধা ছিল তাঁর উপরওয়ালাদের কাছে তা এঁরা ছিড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের নগ্ন স্বার্থের বন্ধন, নির্বিকার নগদ দেনা পাওনা সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই এরা অবশিষ্ট রাখেনি। আত্ম সর্বস্ব হিওসাব নিকাসের ঠাণ্ডা জ্বলে এরা ডুবিয়ে দিয়েছে ধর্ম –উন্মাদনার স্বর্গীয় ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্য বৃত্তির উৎসাহ ও কুপমণ্ডুক ভাবালুতা। লোকের ব্যক্তি মুল্যকে এরা পরিনত করেছে বিনিময়মুল্যে, অগনিত অনস্বীকার্য সনদবদ্ধ স্বাধিনতার স্থলে এরা এনে খাড়া করেছে ওই একটিমাত্র নির্বিচার স্বাধিনতা–অবাধ বাণিজ্য। এক কোথায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মোহগ্রস্থতার মধ্যে যে শোষন এতদিন ঢাকা ছিল, তার বদলে এরা এনেছে নগ্ন, নির্লজ্জ, সাক্ষাৎ পাশবিক শোষণ।
মানুষের যেসব বৃতিকে লোকে এতদিন সন্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণী তাঁদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে……।।।
তারপরের উল্লেখযোগ্য ক্রিটিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের হর্কহাইমার আর আডর্নোর হাতে তাঁদের বিখ্যাত বই ডায়ালেক্টিক অব এনলাইটেনমেন্টের মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীতে মিশেল ফুকো এসে কান্টের সেই লেখার ক্রিটিক করেন। ২০০৩ সালে চমস্কি তাঁর হিজিমনি এন্ড সারভাইভাল বুইতে একটা পরিচ্ছদ লেখেন দ্য নিউ এজ অব এনলাইটেনমেন্ট। সেখানে চমস্কি কৌতুক করেই লেখেন
“অতীতের এনলাইটেনমেন্টের দর্শন ও অর্জন স্তিমিত করে দিয়ে পুরোনো সহস্রাব্দের শেষ বছরগুলিতে অনুরুপ অনেক অত্যুৎসাহী আত্মতুষ্টির প্রচার প্রসার হয়েছিল–কিন্তু বর্তমানের উৎসাহ সেইসব অতীতকেই স্তিমিত করে তুলেছে। সবাই মিলে বিশ্বে সকল “অমানবিক কর্মকাণ্ডে”র সমাপ্তি টেনে এক আদর্শ ভিত্তিক নতুন বিশ্ব তৈরি করার ইচ্ছায় মেতে উথেছে–“সুনীতি” ও যথাযথ মুল্যবোধের প্রেক্ষিতে এই সদিচ্ছা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বলে মনে করা হচ্ছে। এতেই সুচনা হল একটা নতুন এনলাইটেনমেন্টের–অ্যামেরিকার নেতৃত্বে সভ্যভব্য দেশগুলো এতে অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাঁর “শৌর্যের চরমে” সুউচ্চ আদর্শের পেছনে পরহিতব্রত এবং নৈতিক আবেগ নিয়ে ছুটছে।“ ফুকো লিখেছিলেন, “আধুনিকতার বিশেষত্ব নির্ণয় করতে কিছু চেতনা কাজ সময়ের মধ্যে ভাঙন, ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ, নতুনত্বের অনুভুতি, চলমান সময়ের ঘুর্নী। তিনি আধুনিকতা সম্পর্কে বোদলেয়ারের একটা চমৎকার উক্তি বলেছেন “আধুনিকতা একটি তুচ্ছ ক্ষণস্থায়ী ও আকস্মিক বিষয়”।
এনলাইটেনমেন্ট অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার এবং প্রক্রিয়ার সমস্টিগত রূপ। ফুকো কান্টের কথার বিপরীতে দাড়িয়ে ঘোষণা করেন, এনলাইটেনমেন্ট আমাদের সাবালকত্ব অর্জন করিয়ে দেয় নাই। অনেকেই মনে করেছেন যে এনলাইটেনমেন্টের বিশ্বজনীন মূল্যবোধ মূলত সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারায় উজ্জীবিত ছিল ।
ডায়ালেকটিক অফ এনলাইটেনমেন্ট বইটির মূল বক্তব্য ছিল যে, শুরুতে এনলাইটেনমেন্ট চার্চের বিরুদ্ধে ও সেইসঙ্গে চার্চের দেবতাদের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক মতামত প্রতিষ্ঠিত করলেও শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন সকল অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স এমনকি মানবজাতির বিবেক এবং মুক্ত চিন্তারও বিরোধী হিসাবে দেখা দিয়েছে । হর্কহাইমার আর আডর্ণোর মতে ‘জ্ঞান’ এখানে ‘তথ্য’ থেকে ছিটকে পড়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর মুক্তচিন্তার সমর্থক নয়, বরং বিজ্ঞান এখন প্রকৃতিকে দমন করার শক্তি। যার বেশী টাকা বিজ্ঞান তাঁর কাছেই বিক্রি হবে।
এনলাইটেনমেন্ট প্রগতির পথে ইউরোপকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বলে যে দাবী করা হয় বাস্তবে মোটেও তা হয় নি । এনলাইটেনমেন্ট ও প্রগতির সম্পৃক্ততার ধারণা ভ্রান্ত । যা অর্জিত হয়েছে তা হোল এনলাইটেনমেন্টে থেকে ইউরোপ আবার পিছনের দিকে ফিরে গেছে। ধনুক তীর ব্যবহৃত না হয়ে মানুষ মারায় আনবিক বোমা ব্যবহৃত হচ্ছে।, কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প হয়েছে। শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উনারা বলেছেন ইউরোপের বুর্জোয়াদের সাংস্কৃতিক মান অতন্ত্য নিম্ন স্তরের আর এই নিম্নমানের বুর্জয়ারাই এনলাইটেনমেন্টের গুণগান করে। হর্ক হেইমার ও অ্যাডর্নো এনলাইটেনমেন্টের দুটো গুনগত অর্থ বের করেছেন । একটা হোল “গনতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে” উঠতি বুর্জোয়াদের দার্শনিক চিন্তা ভাবনা বা দুশ্চিন্তা; অপরটি প্রগতির বিপরীতে সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ধারণা।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এনলাইটেনমেন্ট ফ্যাসিবাদের জন্মের ইন্ধন জুগিয়েছে। হেইডেগারের পরেও অনেক দার্শনিক গেডামার থেকে দেরিদা পর্যন্ত বিশ্বাস করতে রাজি নন যে এনলাইটেনমেন্ট একটা নতুন আত্মসচেতন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছিল । তাদের মতে এই সুন্দর দার্শনিক ও সাহিত্যিক সময়টাতেই পুঁজিবাদ, ঔপেনিবেশিকতা এবং একদলীয় রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার শুরু হয় ।
পৃথিবীকে যা কিছু এগিয়ে নিয়ে গেছে তার মধ্যে এনলাইটেনমেন্ট একটা গুরুত্তপুর্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট পৃথিবীর নিয়তি নয়। এনলাইটেনমেন্টের যুক্তিশাসিত লোহার খাচা যা দিয়েছে মানব জাতিকে কেড়ে নিয়েছে তার চেয়েও বেশী। এই এনলাইটেনমেন্টে পৃথিবীর ইতিহাস যারা আটকে রাখতে চায় তারা আর যাই হোক প্রগতিশীল নয়।