আখ যে সোমরস সেটা আমরা ভুলে গেছি

সোমরস ঋগ্বেদে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। দেবতাদের পূজায় সোমরস তাঁদের উদ্দেশ্যে আগুনে আহুতি দেয়া হতো। এটিকে ইন্দ্রের প্রিয় পানীয় ছিল। এতদিন জানতাম সোমরস মানে সেই সময়ের পাগলা পানি বা অগ্নিজল বা মদ্য। এমনটাই বলেছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা যা কোনদিন যাচাই করে দেখা হয়নি। ভাবতাম আহা, এমন স্বর্গীয় পানীয় কোথায় গেল? এবার আসুন দেখি এটা আসলে কী ছিল?

সোমরস আসতো সোমলতা থেকে। সোমরস সুমিষ্ট, এই রস যেমন পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তেমন দুধ, দধি ও ক্ষীরে দেয়া হতো মিষ্টতার জন্য। দুধে নিশ্চয় মিষ্টতার জন্য মদ মেশানো হবে না। এই সোমলতা কোথায় গেল? একটা সেলিব্রেটেড উদ্ভিজ প্রজাতি নিশ্চয় হারিয়ে যায়নি? হতে পারে, শুধু আমরা প্রাচীন নামটা ভুলে বসে আছি। এবার আসুন দেখি সোমলতার কী কী বর্ণনা দেয়া আছে ঋগ্বেদে আর প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতে।

ঋগ্বেদের ৯ মণ্ডলের ৬৬ সুক্তে সোমরস সংগ্রহ ও শোধন সম্পর্কে বলা আছে। “এর ধারা হরিৎ বর্ণ, কখনো শুভ্র বর্ণ বা কখনো ঈষৎ লোহিত বর্ণ। একে পীড়ন বা প্রস্তর খণ্ডের মাঝে রেখে পেষণ করে উৎপন্ন করতে হয়। সোমলতা বিচিত্র কুশযুক্ত। দুটি কুশ বক্রভাবে শোভিত হয়। এই সোমলতা বর্ষজীবী। কুশের অগ্র তীক্ষ্ণ ও বৃষভের শৃঙ্গের মতো। সোমলতা সোনালি হরিৎ বর্ণের নিটোল, গোলাকার, লম্বা, সরল। সোমলতার দেহকাণ্ড থেকে আরেক সোমলতা জন্মায়।”

এবার বুঝতে পারছেন? এটা আমাদের আখ??!!

যুদ্ধে যাবার আগে সোমরস পান করতো যোদ্ধারা। এ থেকে ইনস্ট্যান্ট গ্লুকোজ পেয়ে যোদ্ধারা যুদ্ধের শক্তি পেত। ঈষৎ মজে যাওয়া সোমরস মত্ততাও দিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মান সেনাদের সুগার কিউব দিত যুদ্ধে যাবার আগে।

তবে আখের রস রেখে দিয়ে মজিয়ে যে মদ্যজাতীয় পানীয় তৈরি করা হতো সেটাও সত্য। কারণ সোমরস পানে মত্ততার উল্লেখ আছে ঋগ্বেদেও।

বৈদিক আন্দোলনে বাঁধ ভেঙে ফেলার যত যুদ্ধ হয়েছে সেখানে সোমরসের দরকার ছিল যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরির জন্য। কিন্তু পরবর্তীকালে বৈদিক সমাজ মদ্যপানকে নিন্দনীয় কিংবা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলো। তাই সোমরসের প্রচলিত অর্থ রক্ষা করা বৈদিক ঋষিদের জন্য এবং ধর্মের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিল। তাই এটাকে দেবতাদের অতীতের ব্যবহৃত পানীয় হিসেবে দেখাতে গিয়ে এর অর্থ বিলুপ্ত করে দিতে হয়েছে। বিশেষত বৈদিক অপৌত্তলিক বা নিরাকার দেবতাদের পুজা পদ্ধতির অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের উদ্দেশ্যে অগ্নিতে সোমরস আহুতি দেয়ার প্রয়োজন ফুরালে সোমের অর্থ ভুলিয়ে দেয়া সহজ হয়েছে। এভাবেই আমাদের চির পরিচিত আখ যে সোমরস সেটা আমরা ভুলে গেছি। চমস্কির নেসেসারি ইলিউশন  যারা পড়েছেন, এই পদ্ধতি কতখানি কার্যকর সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।

এবার হয়ে যাবে নাকি এক গ্লাস চনমনে সোমরস? 🙂

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Feeling social? comment with facebook here!

Subscribe to
Newsletter